'ক্ষুধা'। দু'অক্ষরের শব্দ। যা সেই আদিযুগ থেকেই বেঁধে রেখেছে মানবজাতির অস্তিত্বের একটা বড় অংশকে। জাতির সুখ-দুঃখ, আশা-আনন্দ, চিত্ত-চেতনার যে ধার ও ভার, তা পুষ্টই হতে পারে না খাবার না পেলে। বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে রয়েছে সেই অংশ, যা একটি চিরন্তন সত্যকেই প্রথম শুনিয়েছিল ক্ল্যাসিক সাহিত্যের ভাষায়। যেখানে বলা হয়েছিল- খিদের জ্বালায় মানুষ আসলে কী করে? প্রথমে ভিক্ষা এবং তারপর সেটা করার শারীরিক শক্তি না থাকলে তখন উপবাস। অনন্ত ও শরীরের শেষতম বিন্দু কাঁপিয়ে দেওয়া উপবাস। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেশের কোটি কোটি নাগরিককে এখনও সেই অনন্ত উপবাসের অন্ধকার থেকে মুক্ত করা গেল না। ২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১১১।
সমাজের নানা স্তর থেকে দারিদ্র কিছুটা কমলেও, পরিপার্শ্বের তুলনায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির দাপট কমেনি, বরং বেড়েছে। এর কারণ বিবিধ ও বহুমাত্রিক। আয় সামান্য বাড়লে ভোক্তার আগ্রহ পুষ্টির থেকে মনোহারী বা বিলাসবহুল পণ্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াই নয়, পর্যাপ্ত বৃদ্ধির জন্য আবশ্যক যে পুষ্টি, তার প্রতি বহুস্তরীয় উদাসীনতাও তৈরি হয় বলে দেখা যায়। পরিবারের ভিতরে লিঙ্গবৈষম্য, জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যাভ্যাস-সহ বিভিন্ন এককে এর বিস্তার ধরতে পারা যায়। একটি সচ্ছল পরিবারের একটি সন্তান পরিপুষ্ট এবং অন্যটি অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণের ফলে রুগ্ণ- এই ছবিও আশ্চর্যের নয়।
২০২১ সালে বিশ্বের ১১৬টি দেশের মধ্যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের স্থান ছিল ১০১। ২০২০ সালে ভারত ছিল এই তালিকার ৯৪ নম্বরে। ২০২২ সালে ভারতের স্থান ১০৭। ২০২৩ সালে আরও কমে হয়ে গেল ১১১। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ২০২১-২২ সালে ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকী নেপালের মতো দেশ। ভারতের আর এক প্রতিবেশী চিন তখনও ছিল এবং ২০২৩ সালেও রয়েছে এই তালিকার অন্যতম শীর্ষে। এই চিত্র অবশ্য শুধু ভারতেরই নয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই। প্রতি বছর এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মাতে যত মানুষ মারা যান, তার থেকে বেশি মানুষ মারা যান না-খেতে পেয়ে। ক্ষুধায়।
কোভিডের ফলে বহু দেশের খাদ্যের যোগানেই টান পড়েছে বিপুলভাবে। রোজ রাতে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর পরিসংখ্যান থেকে বছরখানেক আগেই বেরিয়ে এসেছিল এই ভয়ঙ্কর ছবি। অতিমারির দুটো বছর গোটা দুনিয়াকেই দাঁড় করিয়েছে প্রবল ক্ষুধার সামনে- ২০১৯ সালে, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত আগে, গোটা দুনিয়ায় সাড়ে তেরো কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার তীব্র অভাবে ভুগতেন; বর্তমানে সংখ্যাটি তার প্রায় কয়েক গুণ।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বিপুল ক্ষুধার নেপথ্যে চারটি জরুরি কারণ তুলে ধরেছিল- ১) যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অশান্তি, ২) বিশ্ব উষ্ণায়ন ৩) কোভিড ৪) খাদ্যপণ্যের বর্ধিত মূল্য। খাদ্যের যোগান কমায়, উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক জ্বালানি সঙ্কটের ফলে সারের দাম বেড়েছে বিপুল ভাবে, জ্বালানির খরচ বাড়ায় পরিবহণ ব্যয়ও বেড়েছে- ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব খাদ্যের বাজার থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। আফ্রিকার বহু দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের রফতানির উপর নির্ভর করে থাকায়, সেইসব দেশেও খাদ্যহীনতা থেকে উদ্ভূত তীব্র ক্রোধ ও হতাশা জন্ম দিয়েছে সর্বগ্রাসী জনরোষের। যা ক্রমে বিপজ্জনক আকার ধারণ করেছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নিকট অতীতের উদাহরণও টেনেছিল।অর্থের অভাবের ফলে ২০১৫ সালে সংগঠনটি সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য খাবারের জোগান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ার পরই ইউরোপের ইতিহাসে বৃহত্তম উদ্বাস্তু সঙ্কট তৈরি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ এই পরিস্থিতিতে জানিয়েছিল, যে অনুন্নত দেশগুলিতে খাদ্যসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে, তাদের যদি সেই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মতো সামর্থ্য জোগানো না যায়, তবে আবার উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে চাদ, মাদাগাস্কার, সোমালিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিকের মতো দেশগুলি রয়েছে ক্ষুধা সূচকের একেবারে নীচের দিকে। ২০১১ সালে যখন প্রথমবার বিশ্ব ক্ষুধা দিবস পালন করা শুরু হয়, তখন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল- ক্ষুধা সম্পর্কে বিশ্ব-সমাজের নানা ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানো। পরে তা কিছুটা বদলে গিয়ে এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য হয়- বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমস্যার মোকাবিলার উদ্যোগ নেওয়া।
দিবস আসে। ২৪ ঘণ্টা বাদে চলেও যায়। সাধিত হতে না পারা মূল উদ্দেশ্য ক্রমে ঢেকে যেতে থাকে অন্ধকারে। খিদের অন্ধকার। খিদে। খাদ্য। দিবস-রজনী যার আশায় পেটে ধিকিধিকি তুষের আগুন জ্বালিয়ে বেঁচে থাকে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যাওয়া ক্ষুধার রাজ্যের প্রতিটি নাগরিক।