আবেগহীন বোঝাতে কতবার এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়। পাথর! কেউ শোকে পাথর হন, কারোর মন শক্ত হতে হতেই নাকি পাথর হয়ে যায়। কিন্তু না... পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। পাথর আর আবেগহীনতার প্রতীক থাকছে না। একাকিত্ব ভুলতে কত মানুষ ঘরে পাথর পুষছে, জানেন?
পাথর পোষা? কেন বললাম জানেন, পোষ্য ঘরে থাকলে একলা লাগে না, এ তো খুব চলতি একটি ধারনা। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্প্রতি পাথরকেই পোষ্য ভাবছেন অনেকে। ঘরে পাথর জমাচ্ছেন, তাতে আঁকি বুকি কেটে নাক চোখ মুখ আঁকছেন, পোশাক পরাচ্ছেন। তাদের ডাকনাম দিচ্ছেন। কেন? একাকিত্ব ভুলতে।
একটা পাথর মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছে, একলা লাগার ক্ষতয় মলম লাগাচ্ছে। আচ্ছা, পাথরের বদলে রক্ত মাংসের পোষ্যে কি ভাল বিকল্প নয়? আসলে পোষ্যর যত্ন আত্তি বেশি দরকার। পোষ্য ঘরে রাখতে গেলে, খরচও অনেক বেশি। তার চেয়ে পেট স্টোন অনেক ভাল। কোভিডকাল থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ার দোকানে দোকানে এখন পেট স্টোনের চাহিদা বাড়ছে।
একাকিত্ব গিলছে গোটা দুনিয়াকেই। জাপানে মানুষ হিকিকোমরিতে আক্রান্ত। ছ'মাস বা তারও বেশি সময় ধরে জাপানিরা চলে যাচ্ছেন সামাজিক আইসোলেশনে। কেন? আধুনিক জীবনের স্ট্রেস, উদ্বেগ, মাত্রাতিরিক্ত চাপ, ইঁদুর দৌড় এই সবের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেই ঘিরছে একাকিত্ব। তখনই সব ছেড়েছুড়ে জাপানিরা চলে যাচ্ছেন সামাজিক জীবন থেকে অনেক দূরে।
অতিমারীর সময়ে থাইল্যান্ডের রেস্তোরাঁয় প্রায়ই দেখা যেত একটা দৃশ্য। টেবিলে খাবার, দুধারের চেয়ারের একটায় কোনও ক্রেতা, অন্যটাই একটা খেলনা পান্ডা। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এ মানুষের একলা লাগত, কিন্তু সঙ্গী কই? অভাব পূরণ করত ওই সাদা-কালো খেলনা পান্ডা।
Global State of Connections Report বলছে, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বের প্রায় ১২৫ কোটি মানুষ স্বীকার করেছেন তাঁদের একলা লাগে, অনেকেরই একাকিত্বের মাত্রা অনেকটা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলে, পৃথিবীর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ একাকিত্বের শিকার। বয়ঃসন্ধিতে প্রায় ১০ %, এবং বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ২৫ % ছড়িয়েছে এই সামাজিক সমস্যা।
নিউইয়র্কের কথা বলি? সেখানে তো গত বছর নিয়োগ করা হল একাকিত্বের রাষ্ট্রদূত। পোশাকি নাম লোনলিনেস অ্যাম্বাসাডর। সে দেশেও মহামারির মতো ছড়িয়েছে একাকিত্ব। অতিমারী পরবর্তী সময়ে আরও বাড়ছে সমস্যা।
ছবিটা কমবেশি ভারতেও একই। ফারাক একটাই। একাকিত্ব, অবসাদ নিয়ে কথা বলাটা এ দেশে এখনও ট্যাবু। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও হাজারো ফিসফাস। Longitudinal Ageing Study in India বা (LASI) ২০১৭-১৮ সালে ভারতে একটি সমীক্ষা করেছিল। সেই সমীক্ষার হিসেব বলছে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২০.৫ %-মাঝারি একাকিত্বে ভুগছেন এবং ১৩.৩ %-এর একাকিত্বের মাত্রা মারাত্মক।
এই যে এত প্রযুক্তি এল, জুড়ে থাকার এত মাধ্যম এল, অথচ এখনই মনের অন্ধকারগুলো এত বাড়ছে কেন? মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, কানেক্টেড থাকতে যত বেশি ডিভাইস নির্ভর হচ্ছে জীবন, ততো বেশি একলা লাগছে, মনে হচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছি যেন।