অফিসে কতটা কাজ করলে প'রে 'সহি কর্পোরেট' হয়ে ওঠা যায়? এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই এখন ভারতীয় কর্পোরেট জগতে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা ধরনের বিতর্ক। 'সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। রবিবার বাড়িতে বসে স্ত্রীর মুখ দেখার চেয়ে বরং অফিসে এসে কাজ করা ভাল'। সম্প্রতি 'লারসেন অ্যান্ড টুব্রো'-র চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্যমের এমন মন্তব্য ঘিরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে ভারতীয় কর্পোরেট জগত ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।
কর্মীদের সঙ্গে একটি বৈঠকের সময়, সপ্তাহের সাত দিনই তাঁদের কাজের ইচ্ছে থাকা উচিত বলে কর্মীদের উদ্দেশে মন্তব্য করেন সুব্রহ্মণ্যম। বহুজাতিক সংস্থার ওই চেয়ারপার্সন রবিবার সহ ৯০-ঘণ্টার কাজের সপ্তাহের পক্ষে কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, "আমি আফসোস করি যে, তোমাদের দিয়ে রবিবার কাজ করাতে পারি না। আমি যদি তোমাদের রবিবারে কাজ করিয়ে নিতে পারি, তাহলে খুশি হব। ঘরে বসে কী করো তোমরা? কতক্ষণ তোমাদের স্ত্রী'দের দিকে তাকিয়ে থাকো?"
বেশ কয়েকমাস আগে ইনফোসিস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় বিজনেস টাইকুন এন আর নারায়ণমূর্তির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে প্রায় একই ধরনের একটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতীয় কর্পোরেটের চিরাচরিত ৯ ঘণ্টার শিফটের পক্ষপাতী নন তিনি। তিনি নিজে সকাল সাড়ে ছ'টায় অফিসে এসে রাত সাড়ে আটটার সময়ে বেরোতেন। অর্থাৎ, ১৪ ঘণ্টা কাজ করতেন! তিনি চান, এখনকার কর্পোরেটেও যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরাও এই পথেরই অনুসারী হয়ে উঠুন!
ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নিয়ে ইদানিং যে যে নতুন ধারণা তৈরি হয়েছে, তাও তিনি মানেন না বলে ওই সময়ে জানিয়েছিলেন নারায়ণমূর্তি। যা নিয়ে ভারতীয় কর্পোরেট সেক্টরে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে যায়। নারায়ণমূর্তির সেই বিতর্কিত বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনী এবার শোনা গেল লারসন অ্যান্ড টুব্রোর বর্তমান চেয়ারম্যান এস.এন. সুব্রহ্মণ্যনের কথায়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে চালু থাকা মূল শ্রম আইন (১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট) অনুসারে, দিনে আট ঘণ্টা (বিরতি-সহ ন’ঘণ্টা) এবং ওই আইনের ৫১ নম্বর ধারা অনুযায়ী সপ্তাহে দু’দিন ছুটি থাকলে বিরতি-সহ দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করানো যেতে পারে। তবে কোনও অবস্থাতেই সপ্তাহে তা মোট ৪৮ ঘণ্টার বেশি হবে না। নতুন শ্রমবিধিতেও এই আইনটিকে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কিন্তু বিধির খসড়া নিয়মে বলা হয়েছে, সপ্তাহে নিট হিসাবে কাজের সময় ৪৮ ঘণ্টা থাকলেও দৈনিক সময় চাইলে ১২ ঘণ্টা করা যাবে।
যে যে কারণে ফের বিতর্কে উঠে এল ভারতীয় সংস্থার কর্মসংস্কৃতির কথা, তা এবার খতিয়ে দেখব আমরা।
প্রেক্ষাপট:
Larsen & Toubro (L&T)-এর চেয়ারম্যান এস.এন. সুব্রহ্মণ্যন সম্প্রতি ৯০-ঘণ্টা কর্ম-সপ্তাহের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা নিয়ে দেশের কর্পোরেট সেক্টর তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
মন্তব্য:
তিনি বলেছেন, "রবিবার কাজ করলে বেশি উৎপাদনশীলতা সম্ভব," যা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
বিতর্কিত মন্তব্য:
সুব্রহ্মণ্যন বলেন, "কতক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবেন?"- যা অনেকেই নারীবিদ্বেষী বলে অভিহিত করেছেন।
৯০-ঘণ্টার প্রস্তাব:
তিনি দাবি করেছেন, ৯০ ঘণ্টা কাজ করলে ব্যক্তিগত উন্নতি ও দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনা বাড়ে।
চীনের সঙ্গে তুলনা:
চীন দীর্ঘ ওয়ার্কিং আওয়ার্সের মাধ্যমে উন্নতি করেছে বলে সুব্রহ্মণ্যন মন্তব্য করেছেন।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া:
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, অনেকেই এই মতকে অবাস্তব ও অমানবিক বলছেন।
L&T-এর প্রতিক্রিয়া:
L&T দাবি করেছে, এটি তাদের সংস্থা তথা দেশের উন্নয়ন এবং বিকাশের লক্ষ্যে একসঙ্গে মিলেমিশে নিরন্তর কাজ করে চলার আহ্বান মাত্র।
মানসিক স্বাস্থ্য:
৯০-ঘণ্টা কাজের প্রভাব মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন হতে পারে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ
শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা:
ভারতের শ্রম আইন মূলত ব্লু-কলার কর্মীদের রক্ষা করে, কিন্তু হোয়াইট-কলার কর্মীরা অনেকাংশে সুরক্ষিত নয়।
কাজের পরে কাজ নয়:
রাইট টু ডিসকানেক্ট। অর্থাৎ, কাজের সময়ে কাজ, শেষ হওয়ার পরে আর কাজ সংক্রান্ত কোনও কথোপকথন বা সহায়তা না করার অধিকার রয়েছে কর্মীর। ২০১৭ সালে ফ্রান্স ছিল প্রথম দেশ, যেখানে এই রাইট টু ডিসকানেক্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে স্পেন, বেলজিয়াম, ইতালি, আয়ারল্যান্ডেও তা চালু হয়।
সপ্তাহে চার দিন কাজ:
কর্মীরা ভাল থাকলে কাজও ভাল হবে। এই ভাবনা থেকেই বহু দেশ সপ্তাহে চার দিন কর্মদিবসের নীতি চালু করেছে। বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জাপান ছাড়াও বহু দেশ রয়েছে এই তালিকায়।
ছুটি বাধ্যতামূলক:
অস্ট্রিয়ায় এক জন কর্মী যদি কোনও সংস্থায় অন্তত ৬ মাস কাজ করেন, তা হলে তাঁর অন্তত পাঁচ সপ্তাহের সবেতন ছুটি প্রাপ্য! এটাই বলা হয়েছে সে দেশের শ্রম আইনে। ভারতের বহু সংস্থায় যেখানে উর্ধ্বতনদের আচরণে ছুটি নেওয়ার জন্য কর্মীদের অপরাধবোধ হয়, সেখানে এই নিয়ম প্রশংসনীয়।
চাকরি না হারিয়েই দীর্ঘ বিশ্রাম:
বেলজিয়ামে এক জন কর্মী তাঁর কাজ থেকে এক বছরের বিশ্রাম নিতে পারেন। তা সত্ত্বেও তাঁর চাকরি যাওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না। এই এক বছরে তিনি কিছু না করতে পারেন আবার পার্ট টাইম চাকরিও করতে পারেন। সরকার তার পরেও তাঁকে নিয়মিত অর্থসাহায্য করবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এই ছুটি বা বিশ্রাম ছ’বছর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে।
সাপ্তাহিক শ্রমের সময়সীমা:
ভারতে এক জন সাধারণ কর্মী সপ্তাহে ৪৬.৭ ঘণ্টা কাজ করেন। সাপ্তাহিক শ্রমের এই সময়সীমা ভারতকে পৌঁছে দিয়েছে সর্বোচ্চ সাপ্তাহিক শ্রমের প্রথম ১৫টি দেশের মধ্যে। দেখা গিয়েছে, ভারতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্মীরা সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টাও কাজ করেন। অথচ ফ্রান্সে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কোনও কর্মীকে কাজ করতে দেওয়া হয় না।
সাম্প্রতিক মৃত্যু:
কয়েক মাস আগেই EY-এর ২৬ বছর বয়সী কর্মী অ্যানা সেবাস্টিয়ানের মৃত্যু অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। তৈরি হয় বিতর্ক।
পাশ্চাত্য মডেল:
পাশ্চাত্যের বহু দেশ কাজের সময় কমিয়ে দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে।
বিলাসের জীবন বনাম কাজ:
বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই কর্মীদের কর্মজীবনের সঙ্গে নিজস্ব দৈনন্দিন জীবনের গুণগত মানের উন্নয়নের ভারসাম্যের লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
কর্মক্ষেত্র সংস্কৃতি:
ভারতে কর্পোরেট সংস্কৃতিতে বিশ্রামহীন কাজের ধারা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে।
উৎপাদনশীলতা বনাম অতিরিক্ত চাপ:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বেশি সময় ধরে কাজ করলেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা:
কর্পোরেট ভারত এবং উন্নয়নশীল ভারত কি পাশ্চাত্যের দেশগুলি এবং চিনের সঙ্গে নিজেদের কর্মসংস্কৃতিতে তফাৎ তৈরি করতে পারবে?
জনতার অসন্তোষ:
বেশিরভাগ কর্মী এই ধরনের প্রস্তাবকে 'অমানবিক' বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
কোম্পানির দায়িত্ব:
কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ কর্মজীবন:
ভারতে ভবিষ্যতে হাইব্রিড মডেল বা ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক কালচারের সম্ভাবনা।
সরকারি হস্তক্ষেপ:
মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলো নতুন শ্রমিক আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে।
শিক্ষা ও সচেতনতা:
এই বিতর্ক কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সাহায্য করছে।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:
ভারতের কাজের সংস্কৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা।
সমন্বয় জরুরি:
কর্মসংস্কৃতিতে ভারসাম্য রেখে জাতীয় উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রয়োজন।