সুভাষ চন্দ্র বসু (Subhash Chandra Bose) বাঙালির এক চিরকালীন আবেগ। তাঁকে নিয়ে নানা গল্পকথা সময়ের সঙ্গে কার্যত মিথে পরিণত হয়েছে। আর সে সবের তলায় চাপা পড়ে গেছে নেতাজির রোমাঞ্চকর জীবনের কিছু আশ্চর্য তথ্য। সেসবেরই কয়েকটা আজ রইল দর্শক পাঠকদের জন্য।
বাঙালি কিন্তু আজও হিরো বলতে বোঝে ঘরের ছেলে সুভাষকে। সেই হিরোর সবচেয়ে হিরোইক যে ঘটনা, সেই ঘটনার সাক্ষী এই গাড়ি, BLA 7169! এই গাড়িতে চড়েই ৮৪ বছর আগে, ১৯৪১-এর ১৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে নিজের বাড়ি থেকে আফগানিস্থান পাড়ি দিয়েছিলেন সুভাষ। ইতিহাস যে ঘটনাকে মনে রেখেছে দ্য গ্রেট এস্কেপ বা মহানিষ্ক্রমণ হিসেবে। সেই ঘটনা ছিল সুভাষ চন্দ্র থকে নেতাজি হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ।
প্রায় দেড়মাস ধরে পরিকল্পনা করার পর ভাইপো শিশির কুমার বসুর সঙ্গে ১৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে বেরিয়ে পড়লেন সুভাষচন্দ্র। আদেশ ছিল, তিনি চলে যাওয়ার পরেই যেন তাঁর ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। সেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তাঁর ভাইঝি ইলা বসু। সকলের সন্দেহ এড়াতে তিনি নিজেই ওই ঘরে একঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নেতাজি চলে যাওয়ার পরও তিনি সকলের সন্দেহ এড়াতে দিনদশেক তাঁকে খাবার দেওয়ার ভান করেন।
সেই রাতে গাড়ি চালিয়েছিলেন শিশির কুমার বসুই। এলগিন রোডের বাড়ি থকে বেরিয়ে , অ্যালেনবাই রোড, ল্যান্সডাউন রোড, এজেসি বোস রোড, হ্যারিসন রোড, জিটি রোড হয়ে পৌঁছে যান ধানবাদে। পরের রাতে বারারি থেকে গোমর স্টেশন অবধি পৌঁছে দিয়েছিলেন ভাইপো। গোমো থকে দিল্লি কালকা মেইল ধরে দিল্লি হয়ে পেশোয়ার পৌঁছলেন নেতাজি।
পেশোয়ার তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন সহকর্মী মিয়াঁ আকবর শা। সেখান থেকে কাবুল। তারপরে ইউরোপ। তারপরে ইউরোপ থেকে এশিয়া এসেছিলেন সাবমেরিনে। ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। তবে, নিজের পৈতৃক বাড়িতে আর কখনও ফেরা হয়নি তাঁর।
এক নজরে জেনে নেওয়া যাক নেতাজি সম্পর্কে কিছু অজনা তথ্য
১৯২১ থেকে ১৯৪১, এই ২০ বছরের মধ্যে মোট ১১ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নেতাজি। তাঁকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল।
১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব ব্যাঙ্ক তৈরি হয়। সারা দেশ থেকেই ব্যাঙ্ক তৈরির জন্য সমর্থন এসেছিল। আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কে (Azad Hind Bank) দশ টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত নোট ছাপানো হত। এক লক্ষ টাকার নোটে ছিল সুভাষ বোসের মুখ।
১৯৪১ সালে ভারত থেকে আফগানিস্থানে প্রবেশের সময় ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন সুভাষ। সে সময়ে নাম ছিল মহম্মদ জিয়াউদ্দিন (Mohammad Jiuddin)। ইওরোপে প্রবেশ করার সময় নাম পালটে তিনিই হয়ে গেলেন অর্ল্যান্ডো মাজোত্তা (Orlando Mazzotta)। জাপানে থাকার সময় ফের নাম বদলে তিনি হয়ে যান মাতসুদা (Matsuda)। ছদ্মবেশ নিতে পটু ছিলেন তিনি।
সালটা ১৯২৫। জেলে বসে সুভাষ চিঠি লিখলেন বন্ধুকে, জানালেন, জেলেই পুজোর অনুমতি মিলেছে। পুজোকে ঘিরেই শুরু হলো লাঠি খেলা, যা আদতে বিপ্লবীদের অনুশীলনের অংশ ছিল। সেই প্রথা মেনেই বাগবাজারে আজও পালিত হয় বীরাষ্টমী।
১৯৩০ সাল। কলকাতার মেয়র তখন সুভাষচন্দ্র বসু। কলকাতা পুরসভার অল্ডারম্যান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় বাগবাজার সার্বজনীনের পুজো বর্তমান চেহারা পায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সহ আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন এই পুজোর সঙ্গে। পুজোয় প্রথমবারই ৫০০ টাকা চাঁদা দিলেন নেতাজি, পুজোর নাম বদলে হলো 'বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও মেলা'।
১৯৪২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে চালু হয় ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’। ১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই এই রেডিওতেই প্রথমবার মহাত্মা গান্ধীকে ‘জাতির জনক’ হিসাবে সম্বোধন করেছিলেন সুভাষ। অথচ সেই গান্ধীর সঙ্গেই নাকি তিক্ত সম্পর্ক ছিল গান্ধীর?
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশদের সঙ্গে ঠিক কতোটা সমঝোতা করা হবে, সেই নিয়ে মহাত্মার সঙ্গে নানা সময়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন নেতাজি। দুই নেতার দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছয়, কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে সুভাষের প্রার্থী হওয়াকে সমর্থন পর্যন্ত করেননি গান্ধীজি।
১৯৩৮ সাল, জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষ বোস সভাপতি নির্বাচিত হলেন, সে সময় সুভাষকে সমর্থন করেছিলেন মহাত্মা। ঠিক পরের বছর ত্রিপুরি কংগ্রেস অধিবেশনেই ছবিটা পালটে গেল একদম। সভাপতি পদের জন্য নেতাজীর প্রতিপক্ষ হিসেবে গান্ধী দাঁড় করাতে চাইলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে। কিন্তু মৌলানা আবুল কালাম নির্বাচনি প্রার্থী হিসেবে নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন। এবার সুভাষের প্রতিপক্ষ হিসেবে গান্ধী নির্বাচনে দাঁড় করালেন পট্টভি সীতারামাইয়াকে। গান্ধীর সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন লড়া, খুব সহজ কথা নয়, চ্যালেঞ্জ নিলেন সুভাষ। এবং জিতলেন, আরও একবার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন নেতাজি।
সেই সময় এল মহাত্মার বিবৃতি, "সুভাষের জয়ে আমি খুশি, কিন্তু পট্টভি সীতারামাইয়ার হার আসলে আমার হার'।