'যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা না কি বড় কেঁদেছে
দেখেছি স্বপন নারদ বচন
উমা মা মা বলে কেঁদেছে৷'
সোনার প্রতিমা প্রাণপুত্তলিকে দেখতে চেয়ে মাতমহৃদয়ের এই আকুল কান্না বাঙালির একান্ত নিজের। অপার বাংলার গ্রাম-শহর-মাঠ-পাথার-বন্দরে দুর্গা তাই যেন কেবল অসুরবিনাশিনী অমিততেজা মহাপরাক্রমী দেবী নন, এই বাংলার মাটি-জল-হাওয়া-কাশের দোলায় ভেসে যাওয়া এক মেয়ে, মায়ের কাছে আসতে চেয়ে যাঁর অনন্ত অপেক্ষা।
কিন্তু দেবীর মর্ত্যে আগমন কবে থেকে হয়ে উঠল একটা গোটা জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক? বনেদি বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে কবে থেকে মাতৃমূর্তির অধিষ্ঠান হল বারোয়ারি বা সর্বজনীন মণ্ডপে? উমার বাপের বাড়িতে আসা কেমন করে প্রাণিত করেছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে, কীভাবে আরো উজ্জ্বল করেছিল স্বাধীনতার সূর্যকে স্পর্শ করার মরণপণ স্বপ্নকে? নাকি উদযাপনে মিশে গিয়েছিল বশ্যতার সংস্কৃতির পরম্পরা?
সব প্রশ্নের খুব স্পষ্ট উত্তর যে পাওয়া যায়, তা অবশ্য নয়। তবে মা দুর্গার পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষ্যে বাঙালির মেতে ওঠার বয়স ৪ শতকেরও বেশি। দিল্লির রাজদরবারে তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল রাজত্ব। বাংলাও তাঁদের অধিকারে। কিন্তু নদী ও জঙ্গলে আবৃত এই জনপদে মাঝেমধ্যেই জ্বলে উঠত বিদ্রোহের আগুন। ১৬০৬ সাল। তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ শুরু হতে ১৫০ বছর দেরি। ভবানন্দ মজুমদারের গৃহে শুরু হল দুর্গা আরাধনা। মঙ্গলকাব্যের পাতায় রয়েছে সেই প্রসঙ্গের অনুপম উল্লেখ।
আরও পড়ুন: চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করে খোলা আকাশেই হয় বাগদিদের কেঁদুয়াবুড়ি-র পুজো
১৬১০ সালে কলকাতায় শুরু হল মাতৃআরাধনা। তখনও কলকাতার ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হয়নি। লর্ড কার্জন পা রাখেননি এই তল্লাটে। সুন্দরবন লাগোয়া সেই জনপদে আরাধনা শুরু হল হিমালয়কন্যার। বনেদি বাড়ির পুজো। কে জানত পরবর্তী কয়েক শতকে সেই উদযাপন হয়ে উঠবে বাঙালির অভিজ্ঞান!
কিন্তু বনেদি বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে দেবীর সর্বজনীন হয়ে উঠতে সময় লেগেছে অনেক। বিশেষ করে শহর কলকাতায় তো বটেই৷ ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া দেখল প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো। সেই সময়টা বড় অদ্ভুত। তখন ভাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি ইংরেজ রাজত্ব। তবে দেশীয় ধনাঢ্যদের বাড়ির দুর্গাপুজোয় ডাক পাচ্ছেন সাহেবসুবোরা। বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তাদের সমাদরই আলাদা। অন্যদিকে গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের আগুন। মা ভবানীর নামে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন প্রান্তিক মানুষক। এই আবহেই দেবীর প্রথম বারোয়ারি মণ্ডপে পা রাখা।
কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো অবশ্য অনেক পরে। ১৯১০ সালে। তখনও বঙ্গভঙ্গের রেশ মিলিয়ে যায়নি। পরের বছর রাজধানী কলকাতা থেকে সরে যাবে দিল্লিতে। ১৯২৬ সালে কলকাতায় হল প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো। ১৯৩০ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণীতে সম্প্রচার করা হল মহিষাসুরমর্দিনী। বাংলার শারদোৎসবের চিরন্তন সুর বেঁধে দিল ওই অনুষ্ঠান।
তিনের দশক থেকেই ক্রমশ বাড়তে লাগল সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা। বনেদি বাড়ির পুজোর আকর্ষণ তো আছেই, কিন্তু হাতে হাত রেখে মাতৃ আরাধনা যেন হয়ে উঠল বিংশ শতাব্দীর বাঙালির সাংস্কৃতির উচ্চারণ। বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে পুজোর আয়োজন ঢুকে পড়ল আমাদের যৌথতায়। এরপর বহু পথ পেরিয়েছে বাঙালির দুর্গাপুজো। আটচালার আভিজাত্যে মিশে গিয়েছে থিমের আড়ম্বর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে, তা আমাদের অনন্ত অপেক্ষা। মা আসবেন। সকল কলুষ, সকল তামস, সকল জরা এবং মৃত্যু ধুয়ে যাবে শরতের অলৌকিক আলোয়। উৎসবের অপাপবিদ্ধ স্পর্শে আমাদের সারা বছরের হেরে যাওয়াগুলি মিথ্যে হয়ে যাবে এই কয়েকটাদিন।
এই অপেক্ষারই অন্য নাম দুর্গাপুজো। বাঙালির নিজেকে ভালবাসার উদযাপন।