কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলোর কথা বললে যে ক'টা নাম মাথায় আসে, তার মধ্যে অন্যতম হল দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির দুর্গাপুজো । ঠিকানা -১৯সি, নীলমণি মিত্র স্ট্রিট । সেখানেই গেলেই চোখে পড়বে বড় জমিদারবাড়ি । সামনে বড় দুর্গা দালান । দালানজুড়ে আঁকা আলপনা । ঝাড়বাতির আলো যেন ঠাকুরদালানকে আরও মায়াময় করে তুলেছে । একটু একটু করে সেজে উঠেছেন দেবী দুর্গা । সেজে উঠেছে মিত্রবাড়িও । এবার ২১৮ বছরে পদার্পণ করল মিত্রবাড়ির পুজো ।
জমিদার বাড়ির পুজো মানেই ইতিহাস, ঐতিহ্যের মেলবন্ধন, সঙ্গে বনেদিয়ানা । মিত্রবাড়ি দুর্গাপুজো দুশো বছর পেরিয়েও নিয়ম-নীতিতে স্বতন্ত্র । এই পুজোর বিশেষত্ব হল, মিত্রবাড়ির দুর্গাপুজো সম্পূর্ণরূপে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত । তার পিছনেও অবশ্য একটা ইতিহাস রয়েছে ।
পুজোর ইতিহাস
মিত্র বাড়িতে প্রথম কালীপুজো শুরু হয় । পুজো শুরু করেছিলেন প্রাণকৃষ্ণ মিত্র । পরে দুর্গাপুজো শুরু করেন রাধাকৃষ্ণ মিত্র । পরবর্তী সময়ে রাধাকৃষ্ণের মেজ ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্র এই পুজোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই পুজো রাজকৃষ্ণ মিত্র বাড়ির পুজো বলে বিখ্যাত । পারিবারিক সূত্র পুজোর দায়িত্ব নেন একে একে অমরেন্দ্রকৃষ্ণ ও মানবেন্দকৃষ্ণ । কিন্তু, মানবেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রের তিন ছেলের কারও পুত্র সন্তান নেই । তাই মেয়েরাই পুজো পরিচালনা করেন । বর্তমানে মিত্রবাড়ির পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বাড়ির মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাস।
পুজো ও প্রতিমার বিশেষত্ব
মিত্রবাড়ির প্রতিমা তিনচালার । পিছনে মঠচৌরির কাজ । সংরক্ষিত ছাঁচেই গড়ে তোলা হয় প্রতিমা । আরও একটা বিশেষত্ব হল দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর দেবীমুখ । কার্তিক ও অসুরের মুখ সাধারণ মানুষের মতো ।
প্রতিমা থেকে পুজোর আয়োজন...সবটাই করেন বাড়ির সদস্যরা । মিত্রবাড়ির দুর্গাপুজোয় প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে যায় বোধনের রীতি । সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত কুমারী পুজো হয় । সন্ধিপুজোয় সাধারণত ১০৮টি পদ্ম দেওয়ার রীতি রয়েছে । কিন্তু, মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজোয় ১০৮টি অপরাজিতা ফুল ব্যবহারের রীতি রয়েছে । নবমীতে হয় হোম । ছাগ বলি প্রথা রীতি আগে থাকলেও, এখন সেই প্রথা অবলুপ্ত । দশমীতে আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতিও ছিল । এখন আর তা হয় না । প্রাচীন প্রথা মেনে মিত্র বাড়ির পুরুষ সদস্যরা কাঁধে করে প্রতিমা বিজর্সন দিতে যান।
ভোগের বিশেষত্ব
মিত্র বাড়ির বিশেষ ভোগ হল মাখনের নৈবেদ্য । মাখনকে তিন কোনা অর্থাৎ মন্দিরের চূড়ার আকারে কেটে দেবীর উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করা হয় । নৈবেদ্যতে সব্জি ও ভাজা হিসেবে দেওয়া হয় ।
নিয়ম-রীতি মেনেই জাঁকজমকভাবে পুজো হয়ে আসছে এখানে । আজও মিত্রবাড়ির পুজো দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এখানে আসেন ।