বিংশ শতকের শুরু থেকে আজ অবধি, অনেকের ‘মেয়েবেলা’র সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে ‘বার্বি’, কালের নিয়মে কখন যেন সেও হয়ে উঠেছে এক্কেবারে ঘরের মেয়ে। শুনলে অবাক হবেন, দুনিয়ার এই সবচেয়ে জনপ্রিয় পুতুলের বয়স প্রায় ষাটোর্ধ্ব। বয়স ৬০ পেরোলে কি হবে? বার্বির সাজগোজ, স্টাইল স্টেটমেন্ট, চুলের রঙ থেকে পোশাকের ডিজাইন- আজও একই ভাবে জনপ্রিয় এবং চর্চিত। দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে গোলাপি পোশাক, একঢাল সোনালি চুলের বিদেশি পুতুল ‘বার্বি’, কখন যেন এই বিশ্বের সমস্ত মেয়েদের বন্ধু হয়ে উঠেছে।
বার্বি কেবলই পুতুল?
‘পুতুল’ এই শব্দকে ‘লঘু’ করে দেখলে বলতে হয়, ‘বার্বি’ একটি খেলনা। কিন্তু এই পুতুলের ইতিহাস মোটেই এত লঘু নয়। ‘বার্বি’ এই বিশ্বের বুকে কেবলই একটি খেলনা হয়ে থাকেনি কোনোকালেই। বরং মুখ বুজে থাকা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা মেয়েদের বন্ধু হয়েছে সে, একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলেছে কনফিডেন্স। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে ‘বার্বি’ নিজেও। প্রজ্ঞা বেড়েছে তাঁর, চেহারায় এসেছে আভিজাত্যের ছাপ, বদলেছে চুলের রঙ, চোখ মুখের ধার, পোশাকের ধরণ-ধারণ। তাই ‘বার্বি’ কেবলই ছোটদের খেলনার পুতুল নয়, বরং এর অর্থ আরও বৃহৎ। সমস্ত বয়সের, সমস্ত মানসিকতার মেয়েদেরই আত্মবিশ্বাসের যোগান দিয়েছে এই পুতুল।
দীপাবলিতে ট্র্যাডিশনাল ‘বার্বি’
এবার বার্বি খাঁটি ভারতীয়ে সাজে। আলোর উৎসব দীপাবলি উপলক্ষে, এই বিদেশিনী গায়ে জড়িয়েছেন এক্কেবারে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক। পুতুল প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘ম্যাটেল’ বার্বিকে সাজানোর গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন পোশাক শিল্পী অনিতা ডোংরেকে। দায়িত্ব পেয়ে, একেবারে ভারতীয় সাজে বার্বিকে সাজিয়ে তুলেছেন এই শিল্পী। এর আগেও ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল সাজে সেজেছে এই পুতুল, কিন্তু দীপাবলির আলো ঝলমলে সাজ এই প্রথম।
দেশি গার্ল ‘বার্বি’
এই বার্বির গায়ের রঙ অতটা উজ্জ্বল নয়, বরং ভারতীয়দের স্কিনটোনকে মাথায় রেখেই তাঁর গায়ের রঙ শ্যামলা। এক ঢাল ঘন চুলের রঙ ও কালো। তাঁর পরনে ফুলেল কাজ করা লেহেঙ্গা, চোলি। সঙ্গে মানানসই সোনালি ঝুমকো, হাতে এক গাছা গোল্ডেন চুড়ি। পায়ে হিল। দুই ভুরুর মাঝে ছোট্ট একটি লাল বিন্দি বার্বির সাজে জুড়েছে ভারতীয় ঐতিহ্যকে।
বার্বিকে সাজিয়ে কী বলছেন অনিতা?
ডিজাইনার অনিতা বার্বি দিওয়ালি ডলের স্রষ্টা। বার্বির জিনাইনার জানিয়েছেন, তিনি বার্বির পোশাক থেকে ঘন নিজের হাতে আঁকতে পেরে যারপরনাই খুশি। তাঁর মেয়েবেলায় এই পুতুলের স্বাদ তিনি পাননি। কারণ সেসময়ে ভারতে বার্বি পাওয়া যেত না। তাঁর প্রত্যাশা এইটুকুই, এই বার্বির মাধ্যমে ভারতের সংস্কৃতি এবং ফ্যাশন সম্পর্কে সারা বিশ্ব জানুক, চিনুক।
ইতিহাসে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ পুতুলের জন্ম:
বার্বির জন্ম ১৯৫৯ সালে। পুতুলের জন্ম দিয়েছিলেন ম্যাটেল সংস্থার অন্যতম কর্ণধার রুথ হ্যান্ডলার। তিনি ছিলেন এক কন্যার বাবা। মেয়ে বারবারার খেলা জিনিসের মধ্যে কেবল ছিল ‘বেবি ডল’, অর্থাৎ বাচ্চা বাচ্চা দেখতে পুতুল। প্রথমত কোনও শিশুকন্যা কেবল খেলার বস্তু হতে পারে না। এরপর তিনি দেখেন তাঁর মেয়ে কাগজ দিয়ে বেশ কিছু পুতুল বানিয়েছে, যেগুলি মোটেই শিশুসুলভ দেখতে নয়।
এরপরেই রুথের মাথায় প্রাপ্তবয়স্ক পুতুল তৈরির চিন্তা আসে। মেয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়েই পুতুলটির নাম রাখেন— বার্বি। সেবছর আমেরিকার এক পুতুল মেলায় বাজারে আসে ‘বার্বি’। প্রথম বছরেই বিক্রি হয় তিন লক্ষ পুতুল। এই মুহূর্তে, ১৫টি দেশে বছরে ৫৮ কোটি বার্বি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছে বার্বি প্রস্তুতকারক সংস্থা ম্যাটেলে। বার্বি ধীরে ধীরে ইতিহাস হল, এক ভাবনা থেকে। মেয়েদের জন্য বার্বি হয়ে উঠল ‘পিঙ্ক রেভোলিউশন’।
বেবি ডল নিয়ে খেলতে খেলতে, প্রথম থেকেই শিশুদের মধ্যে একটা ‘মা’ হয়ে ওঠার প্রবণতা তৈরি হত। অথচ ছেলেদের পুতুল হিসেবে সেসময় বাজারে বিকোচ্ছে মহাকাশচারী, বিমানচালক, ডাক্তার। নানা ধরনের বার্বি বানিয়ে মেয়েদের সামনেও বিভিন্ন রাস্তা খুলে দিতে চেয়েছিলেন রুথ।
সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর:
বার্বি নিয়ে নারীবাদীরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন সময়ে। ফর্সা, সোনালি চুল, নীল চোখের তথাকথিত ‘সুন্দর’ বার্বিকে নিয়ে বর্ণবৈষম্যের প্রসঙ্গ উঠেছে। বার্বি নিজেকে বদলেছে। বার্বি বুঝিয়েছে সব বর্ণের, সব ধর্মের, সব চেহারার মেয়েরাই আসলে বার্বি। এটা কেবল একটি পুতুল নয়, বলা ভাল একটি আইডিয়া। কৃষ্ণাঙ্গিনী, পৃথুলা, খর্বকায়, কালো চুল, খয়েরি চুল, কোঁকড়া চুল, সোজা চুল, মেদযুক্ত -সব রকমের বার্বি এখন বাজারে মেলে।
সিনিয়র সিটিজেন বার্বি ঘর বাঁধবে না?
কত ছেলের ঘুম ওড়াল এই বার্বি, তবে ৬০টি বসন্ত পেরিয়েও সে একাই। বার্বি কি ঘর বাঁধবে না কোনওদিন? বার্বি প্রস্তুতকারক সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল বার্বি মেয়েদের উড়তে শেখায়। তাঁকে বাঁধতে পারে না কেউ, তার কোনও বন্ধন নেই। না আছে পরিবার।