দীর্ঘ কয়েক বছর পর দিদির কাছে ফিরল কানন। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে তৃণমূলনেত্রী আজও ওই নামেই সম্বোধন করেন। বঙ্গজীবনের হালফিলের রাজনীতির মঞ্চের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র কে, তা নিয়ে যদি এই মুহূর্তে ভোট হয়, তবে নিঃসন্দেহে শোভন চট্টোপাধ্যায় বাকিদের গুণে গুণে দশ গোল দেবেন।
দীর্ঘ কয়েক বছরের অভিমানের প্রাচীর ভেঙে ফের দিদির (Mamata Banerjee) কাছে ফিরল কানন। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে (Sovan Chatterjee) তৃণমূলনেত্রী আজও ওই নামেই সম্বোধন করেন। বঙ্গজীবনের হালফিলের রাজনীতির মঞ্চের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র কে, তা নিয়ে যদি এই মুহূর্তে ভোট হয়, তবে নিঃসন্দেহে শোভন চট্টোপাধ্যায় বাকিদের গুণে গুণে দশ গোল দেবেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি গত কয়েক বছর ধরে অনেকটাই দূরে, তবু ক্যারিশমা এতটুকুই কমেনি। বর্ণময় ব্যক্তিগত জীবনের জন্য শোভন ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী আজও সর্বদাই প্রচারের আলোর বৃত্তে । কিন্তু বুধবার তাঁরা যে ফের খবরের শিরোনামে এলেন তার কারণটা অবশ্যই রাজনৈতিক।
শোভন তৃণমূলের সুসময়ের বন্ধু নন, বরং ঘোরতর বাম আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস ছেড়ে একা বঙ্গ রাজনীতিতে বিরোধী শক্তি হিসেবে বুঁদির গড় সামলাচ্ছেন সেই তখন থেকেই কার্যত তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন শোভন। রাজনৈতির জীবনের সেই সুসম্পর্ক গড়িয়েছিল ব্যক্তিগত পরিসরেও। তাই প্রতিবছর মমতার বাড়ির কালীপুজোর তদারকিতে যেমন শোভনকে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যেত, তেমনি ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানেও কালীঘাটের বাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ ছিল বাঁধা। অতএব রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর কলকাতার মেয়র পদের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ তথা ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ নামে দলে পরিচিত শোভন ছিল মমতার কাছে ‘অটোমেটিক চয়েস’। কিন্তু মমতা ও শোভনের সম্পর্কের সেই বসন্ত বেশিদিন স্থায়ী হল না।
শোভন একা নন, একদা মমতার ছায়াসঙ্গী বা তাঁর বিশ্বস্ত ছিলেন এমন অনেক নেতার সঙ্গেই মমতার বিভিন্ন সময়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যেমন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, সোনালী গুহ। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে শোভনের একটা মূলগত পার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বাকীদের সঙ্গে মমতার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, কিন্তু শোভনের সঙ্গে মমতার দূরত্ব তৈরির পেছনে রাজনীতি নয়, ছিল ব্যক্তিগত কারণ। স্ত্রী রত্নার সঙ্গে বিচ্ছেদ, বৈশাখী বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি দলেও একটা সময় শোভনকে নিয়ে তুমুল গুঞ্জন শুরু হয়। নেত্রী নাকি বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেননি। তিনি নাকি অনেকবার কাননকে ‘বোঝানোর’চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সেই ‘বোঝানোয়’ কাজ হয়নি, বরং তার ফলশ্রুতিতে কাননের সঙ্গে দিদির সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। এর জেরেই একসময় তৃণমূল ছেড়ে বেড়িয়ে যান শোভন ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী দুজনেই। তিনি যে ক্ষমতালোভী নন, তা বোঝাতে দল ছাড়ার পাশাপাশি শোভন ছেড়ে দেন কলকাতার মেয়রের পদ সহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীত্বও।
বাংলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে তৃণমূল ত্যাগ করার পর অনিবার্য গন্তব্য অবশ্যই প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। শোভন ও বৈশাখীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু দক্ষ সংগঠক, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শোভনকে বিজেপি সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি, নাকি শোভন নিজেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে সেভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না - তা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু ঘটনা এটাই যে, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর আর শোভনকে সেভাবে বাংলার সক্রিয় রাজনীতিতে আর দেখা যায়নি। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেলেও ব্যক্তি শোভন বা রাজনীতিবিদ শোভনের মুখে কখনও সেভাবে তৃণমূল বা তার নেত্রীর সমালোচনা শোনা যায়নি। অর্থাৎ তৃণমূল ত্যাগ করলেও দলের সঙ্গে শোভনের কোথাও যেন সর্বদা একটা আলগা যোগসূত্র ছিলই। শোভনের সঙ্গে যখন তাঁর স্ত্রী রত্নার আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে। যখন প্রকাশ্যেই তাঁরা দু’জন পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছেন, তখন গত বিধানসভা ভোটে শোভনের কেন্দ্রে রত্নাকে টিকিট দেয় তৃণমূল। রত্না ভোটে জিতেও যান। অনেকের মতে এভাবে তৃণমূল শোভনের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছে। কিন্তু তারপরেও তৃণমূল বা মমতা সম্পর্কে শোভনের মুখে কোনও সমালোচনা শোনা যায়নি। অর্থাৎ কোথাও যেন দুই তরফেই পরস্পরের কাছে আসার একটা প্রচ্ছন্ন তাগিদ ছিল। আর সেই বৃত্তটাই যেন পূর্ণ হল বুধবারের বারবেলায়।
যে বান্ধবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, বুধবার সেই বান্ধবী বৈশাখীকে নিয়েই শোভন নবান্নে যান মমতার সঙ্গে দেখা করতে। তিনজনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় যার অনেকটাই বৈশাখীর কথায় — ‘রাজনৈতিক আলোচনা’। আর শোভন কী বললেন ? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ জবাব, ‘আমার রাজনৈতিক জীবন—সবটাই মমতাকেন্দ্রীক।’ তাহলে কি ফের তৃণমূলের সক্রিয় রাজনীতিতে শোভন—বৈশাখী জুটিকে দেখা যাবে? ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে কি মমতার পাশে বসবেন কানন? ঘরওয়াপসির এই আবহে তেমনটাই আশা করছে রাজনৈতিক মহল।