আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে৷ বিরাম নেই বৃষ্টির। কিন্তু এত বড় দুর্যোগেও থেমে থাকেনি বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয়ে গিয়েছে উৎসব। মল্ল রাজারা আর নেই, নেই রাজ্যপাট। কিন্তু ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় মল্লরাজাদের অতিসমৃদ্ধ ইতিহাসের পদধ্বনি।
প্রাচীন রীতি ও ঐতিহ্য মেনে 'পট পুজো'ই এখানকার বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা আজও ফি বছর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়।
প্রাচীন প্রথানুযায়ী পট পুজোর পরে তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামানের তোপশব্দ করা হয়। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তোপধ্বনি হয়। পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরো তিনবার কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয়।
দেবী পক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকরুন অর্থাৎ দেবী সরস্বতী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকরুন অর্থাৎ দেবী মহাকালীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোটো ঠাকরুন এই তিনজনই দেবী মহামায়ার রুপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়নী পুথি অনুযায়ী পূজিতা হন।
৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ৪০৪ সাল, ৩০৩ মল্লাব্দে তৎকালীন রাজা জগৎ মল্ল বিষ্ণুপুরে দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি মল্ল রাজাদের কূলদেবী। অতীতে রাজাদের আমলে যে আড়ম্বর ছিল সময়ের দাবি মেনে তাতে কিছু ভাটা পড়লেও শহরবাসীর মধ্যে উৎসাহ এতোটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে। অন্যান্য পুজো কালিকাপূরাণ মতে হলেও এই রাজ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারে বলিনারায়ণী মতে দুর্গাপূজা হয় বলে দাবি করা হয়। একসময় এখানে পূজোয় বলি প্রথা চালু থাকলেও রাজা হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেওয়ার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলি প্রথা।
তোপধ্বনির শব্দকে ব্রহ্ম হিসেবে ধরে সেই সময় থেকেই পাহাড়ের উপর কামানের তোপধ্বনির রীতি চালু বলে জানা গেছে। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর অষ্টমীর দিন থেকেই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্ট ধাতু নির্মীত বিশালাক্ষ্মী ও নবমীর রাতে খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয়। বিজয়া দশমীতে দেবী মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোট ঠাকুরাণীর ঘট বিসর্জন হয়। সব শেষে এই তিন ঠাকুরাণীর পট রাজবাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে যাওয়া হয়।
North Bengal Rain: পুজোতেও বৃষ্টি রাজ্যে? আগামী ২ দিন ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভীড় করেন। সব মিলিয়ে মল্লরাজারা থাকলেও তাঁদের কীর্তির জেরে বিষ্ণুপুর আছে বিষ্ণুপুরেই।