আমাদের দেশ গ্রীষ্ম প্রধান। বছরের একটা সময় শীত আসে এখানে। হেমন্তর মনোরম ভাব কাটিয়ে এবার দেশে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে শীত। এই সময়টার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন দেশবাসী। আর এই শীতের অপেক্ষায় থাকে একঝাঁক প্রবাসী পাখিদেরও। ঠিকানা বদলিয়ে হাজার হাজার মাইল উড়ে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে দিন কয়েকের জন্য ঘর বাঁধে রকমারি সব পাখি। পৃথিবীর নানা অবিশ্বাস্য এবং আকর্ষণীয় ঘটনার মধ্যে একটি হল এই পাখিদের মাইগ্রেশন। দেশের সীমানা পেড়িয়ে কোন শক্তিতে তারা উড়ে আসে? তাদের রাস্তাই বা চেনায় কে? কতদিন ধরে উড়ে আসে? বিশ্রাম নেয় কোথায়? কেই বলে দেয় বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে?
এই মাইগ্রেশনের কারণ কী?
এভিয়ান মাইগ্রেশন একটি প্রাকৃতিক অলৌকিক ঘটনা। নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দু’টি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই বোঝায়। এর পোশাকি নাম সাংবাৎসরিক পরিযান। যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। তাঁদের মাইগ্রেশনের বেশ কিছু কারণ আছে। মূলত তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, উপযুক্ত পরিবেশ এবং প্রজননের সুযোগের খোঁজে তারা অভিবাসন করে থাকে।
কিছু পাখি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থির থাকে না, কারণ তারা যেখানে থাকে সেখানে খাদ্য সরবরাহ কমে যেতে পারে। তারা আরও ভালো খাদ্য সংস্থান খোঁজার জন্য দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ করে। শীতকালে অনেক পাখি ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে চলে যায়, যেখানে তাপমাত্রা আরও সহনশীল এবং খাদ্য পাওয়া যায়। গরম মাসে আবার তারা উষ্ণ অঞ্চলে ফিরে আসে।শীতকালে অনেক পাখি ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে চলে যায়, যেখানে তাপমাত্রা আরও সহনশীল এবং খাদ্য পাওয়া যায়। গরম মাসে আবার তারা উষ্ণ অঞ্চলে ফিরে আসে। কিছু পাখি উষ্ণ বা ঠাণ্ডা অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে সুস্থ থাকতে পারে। তারা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে চায় যেখানে রোগ বা শিকারীদের ঝুঁকি কম থাকে।
কে পথ চেনায় তাঁদের?
পরিযায়ী পাখিরা কীভাবে পিন-পয়েন্ট নির্ভুলতার সাথে নেভিগেট করতে পারে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। পরিযায়ী পাখিরা কীভাবে তাদের উড়ানের পথ খুঁজে পায় তা পুরোপুরি বোঝা যায় না। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন , দিনের বেলা সূর্য এবং রাতে তারার দ্বারা তারা দিক নির্দেশ করে। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে প্রায় ১৯% পাখিই পরিযায়ী।
বাংলাতে কোথায় কোথায় আসে ভিনদেশের পাখিরা?
বিশেষত শীতকালীন সময়ে পরিযায়ী পাখিরা বিভিন্ন দেশ থেকে উড়ে আসে বাংলার বিভিন্ন জায়গাতেও। সুন্দরবন হল একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি এবং এখানকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা আসে। শীতকালে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে, এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি যেমন পিলগ্রিম, সোনালি হাঁস, বার-হেডেড গুজ, রেড-নেকেড গুজ প্রভৃতি পাখি আসতে দেখা যায়। বর্ধমান জেলার বকুলপুরে প্রতি বছর বহু পরিযায়ী পাখি আসে, বিশেষ করে জলাশয়গুলিতে।জলপাইগুড়ি জেলাতেও শীতকালে এসে বাসা বাঁধে পরিযায়ী পাখির দল। দার্জিলিং এবং সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে শীতকালে কিছু পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। এসব পাখি অধিকাংশই হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসে। কলকাতা শহর এবং আশেপাশে যেমন কাঁকুড়গাছি, মহেশতলা, নোয়াপাড়া, সল্টলেক প্রভৃতিতে পরিযায়ী পাখিরা আসেন, বিশেষ করে শীতকালে এখানে শাপলার পাখি, ভদ্র পাখি, জলহংস, প্লামবেড পাখি ইত্যাদি দেখা যায়।
আসলে, পরিযায়ী পাখিরা এক বিশেষ রহস্যের প্রতীক, যারা প্রতি বছর নির্দিষ্ট পথে, নির্দিষ্ট সময়েই নিজেদের যাত্রা শুরু করে। তাদের যাত্রা আমাদের শেখায় পরিসমাপ্তির পরও নতুন সম্ভাবনার সূচনা। পাখিরা যে ভ্রমণ করে, তা কেবল স্থানান্তর নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা, যেখানে তারা নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়, অজানায় তবুও এক ধরনের শান্তির অনুভব নিয়ে। এরা জানে, অন্ধকারে আলো খুঁজে বের করার এক ধরনের অদৃশ্য শক্তি আছে তাদের মধ্যে।