আরও একটি সাইক্লোন। উৎসস্থল ফের সেই বঙ্গোপসাগর। ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপ, আর তা শক্তি বাড়িয়ে তৈরি করে ঘূর্ণিঝড়। বারবার বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে বারবার ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়! গত দেড়শো বছরের ইতিহাস হিসেব করলে দেখা যায়, বারবার বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূল। প্রভাব পড়েছে, বঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাতেও।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৯০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৪০০টির বেশি ঘূর্ণাবর্ত হয়েছে ওড়িশা উপকূল। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে কখনও সুপার সাইক্লোন, কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও বা প্রবল নিম্নচাপে প্রভাব পড়ে উত্তর পূর্বের রাজ্য ওড়িশা ও বাংলায়। সাগরে ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপের প্রভাব পড়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতেও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সবথেকে ভয়াল রূপও দেখেছে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল। ২০০৪ সালে সুনামিতে এই রাজ্যগুলি তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু বারবার বঙ্গোসাগরে কেন তৈরি হয় নিম্নচাপ! কীসের প্রভাবে শক্তি বাড়িয়ে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়গুলি!
আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগর উপকূল বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। আবহাওয়াবিদদের পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ২৯৩টি নিম্নচাপ হয়েছে। উপকূলে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৭টি সাইক্লোন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়গুলিতে উপকূলবর্তী এলাকার অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। কিন্তু কেন বারবার বঙ্গোপসাগরেই এই ঘূর্ণিঝড় হয়! ভুবনেশ্বর IIT-এর অধ্যাপক সন্দীপ পট্টনায়েক জানিয়েছেন, উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন হওয়ায় বারবার বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় ঘূর্ণাবর্ত। কখনও তা শক্তি হারিয়ে নিম্নচাপ তৈরি হয়। কখনও আবার শক্তি বাড়িয়ে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ধ্বংসলীলা চালায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া মধ্য-অক্ষাংশের ঘূর্ণাবর্ত বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তা শক্তি বাড়িয়ে ফেলে। তার ফলেই এই উপকূলবর্তী এলাকায় বঙ্গোপসাগরে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়।
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। অধ্যাপক সন্দীপ পট্টনায়েক জানিয়েছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধিও এ ঘূর্ণিঝড় তৈরির একটা বড় কারণ। বছরে এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠ তেতে থাকে। পূর্ব উপকূলে তাই সবথেকে বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। গবেষণা বলছে, ১৮৯০ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে এই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের হার ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি। ১৯৩০-১৯৬৯ সালে তা কমে হয় ৫ শতাংশ। ২০১০-২০২০ সালে পূর্ব উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের হার বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ওড়িশা উপকূলে বারবার ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা কমতে পারে। কিন্তু ওড়িশা সংলগ্ন উপকূল সীমান্তে ঘূর্ণাবর্তের প্রবণতা বাড়ছে।
তবে শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, আরব সাগরেও ঘূর্ণাবর্ত ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। চলতি বছরই আরব সাগরে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড় রেমাল। গুজরাত উপকূলে আছড়ে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়। এই ঘটনা রীতিমতো অবাক করেছে আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রির বেশি থাকতে হবে। ১৯৭৬ সালে আরব সাগরে এর আগে একটি ঘূর্ণিঝড় হয়। তবে তার তীব্রতা এত বেশি ছিল না। তবে আরব সাগরে নতুন করে ঘূর্ণাবর্ত কেন তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে নতুন করে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।