২৮৭ বছর আগের এক ঘটনা। সেবারও অক্টোবর মাসে এই কলকাতার বুকে এমন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ক্যালকাটা সাইক্লোন। ১৭৩৭ সালে হুগলি নদীবক্ষের সেই ঘূর্ণিঝড়ে সবকিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ক্ষতির পরিসংখ্যান অজানা। বন্দর এলাকায় এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ২০ হাজার টিরও বেশি জাহাজ, ডিঙি, নৌকা, বজরা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পরিবহণ এবং পরিকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে ভেসে যায়। এই মহাঝড়ে ভূপৃষ্ঠের থেকে প্রায় ৩০-৪০ ফুট উপরে উঠে গিয়েছিল জল। বহু গবাদি পশু, বাঘ এবং গন্ডার ভেসে গিয়েছিল সেই তাণ্ডবে।
চলতি বছর মে মাসে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে রেমাল। মৌসম ভবন জানিয়েছে, ২৪ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার মাঝরাত থেকে শুক্রবার সকালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় দানার ল্যান্ডফল হবে। ওড়িশার ভিতরকণিকা থেকে ধামারার মধ্যে ভূভাগে প্রবেশ করবে ঘূর্ণিঝড় দানা। দেশে এখনও পর্যন্ত সবথেকে বড় ঘূর্ণিঝড় কী? গত কয়েক দশকে কোন কোন ঘূর্ণিঝড় সমুদ্র উপকূলে আছড়ে পড়েছে, তার প্রভাবে কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ভোলা সাইক্লোন
বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে যে সব ঝড় হয়েছে, তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর সাইক্লোনগুলির মধ্যে সবথেকে আগে যে নামটি উঠে আসে, তা হল 'ভোলা'। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আছড়়ে পড়েছিল এই সাইক্লোন। বঙ্গোসাগরে তৈরি হওয়া এই সুপার সাইক্লোনে মৃত্যু হয় প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের।
BOB ০১
১৯৯০ সালে বঙ্গোপসাগরে আরও একটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল। যার নাম ছিল সুপার সাইক্লোনিক স্টর্ম BOB ০১। ৯ মে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে এই সাইক্লোন। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এই ঝড়কে। এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৯৬৭ জন।
ওড়িশা সাইক্লোন
১৯৯৯ সালে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়েছিল স্বাধীনতাত্তোর ভারতের অন্যতম ভয়াবহ ওড়িশা সাইক্লোন। ২৯ অক্টোবর উপকূল অঞ্চলে আছড়ে পড়ে এই সাইক্লোন। যার প্রভাবে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৯,৮৮৭ জনের মৃত্যু হয়। ঘরছাড়া হন কয়েক হাজার মানুষ। সাইক্লোন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ডায়রিয়া, কলেরায় মতো রোগে আক্রান্ত হন বহু মানুষ।
সাইক্লোন বিওবি ০৩
২০০০ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ দফতরের তরফে সিদ্ধান্তের ফলে, প্রতিটি সামুদ্রিক ঝড়ের চিহ্নিতকরণের কাজে সুবিধার জন্য ঝড়গুলির নির্দিষ্ট নামকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল সাইক্লোন বিওবি ০৩। মৃত্যু হয় ১৭৩ জনের। ২০০৫ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে কলিঙ্গপটনমে আছড়ে পড়ে সাইক্লোন 'পেয়ার'। যার ফলে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেরশ ও ওড়িশা উপকূলের অন্তত ৬৫ জন মানুষ।
নিশা সাইক্লোন
২০০৮ সালে ডিসেম্বরে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় 'নিশা'। এর প্রভাবে তামিলনাড়ু ও শ্রীলঙ্কা উপকূলে ২০০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে আসে সাইক্লোন 'ফিয়ান'। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছিল তামিলনাড়ু, গুজরাত, গোয়া, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটক উপকূলে।
আয়লা ঘূর্ণিঝড়
২০০৯-এর মে মাসে উত্তর ভারত মহাসাগরে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আয়লা। কলকাতায় থেকে ৯৫০ মাইল দূরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ভারতে আয়লার প্রকোপে কমপক্ষে ১৪৯ জনের মৃত্যু হয়। শতাধিক মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হন। ক্ষতির সম্মুখীন হয় ১৫ হাজার মানুষ।
নীলম
২০১২ সালে দক্ষিণ ভারতের উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় 'নীলম'। ৩১ অক্টোবর মহাবলীপুরমে আছড়ে পড়া এই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটার। মৃত্যু হয়েছিল ৭৫ জনের।
ফাইলিন
২০১৩ সালে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়েছিল 'ফাইলিন। ১৪ বছর আগে, ১৯৯৯ সালে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়া সুপার সাইক্লোনের থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল এই ঘূর্ণিঝড়।
হুদহুদ
২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের ভাইজ্যাগে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝর 'হুদহুদ'। ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় 'হুদহুদ' প্রাণ কেড়েছিল ১২৪ জনের। টানা বৃষ্টিতে কার্যত ভেঙে পড়েছিল এই দুই রাজ্যের মধ্যের যোগাযোগ-ব্যবস্থা।
অক্ষী
২০১৭ সালে আরব সাগরে তৈরি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় 'অক্ষী'। কেরল, তামিলনাড়ু, গুজরাতের উপকূলে আছড়ে পড়া এই ঝড়ের প্রভাবে মৃত্যু হয়েছিল ২৪৫ জনের। ২০১৯ সালে মে মাসে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে 'ফণী' সাইক্লোন। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছিল বাংলাতেও। মৃত্যু হয় ৪০ জনের।
আমফান
২০২০ সালে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে আছড়ে পড়ে সুপার সাইক্লোন 'আমফান'। করোনা-কালে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছিল জনজীবন-সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত পরিষেবা। আমফানের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার।
টাউকটে
২০২১ সালেও একটি ঘূর্ণিঝড় আসে। যার নাম টাউকটে। মায়ানমার এই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছিল। ভারতের তিন রাজ্যে মৃত্যু হয়েছিল ২৪ জনের। ২০২১ সালে ওড়িশার ভদ্রকে আছড়ে পড়ে আরও একটি সুপার সাইক্লোন, 'ইয়াশ'। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০-১৪৫ কিলোমিটার।