কাশ, শিউলি, কিমবা শরতের মেঘ ছাড়া যেমন দুর্গাপুজোর কথা ভাবা-ই যায়না ঠিক তেমনই বছর কয়েক আগে পর্যন্ত কালী পুজোর সময়টা ভাবাই যেত না শ্যামা পোকা ছাড়া। লক্ষ্মী পুজো পেরোলেই ঝুপ করে নেমে আসত সন্ধে, হিমেল ভাব থাকত আকাশে, আর আলো জ্বাললেই ভিড় করে আসত সবুজ সবুজ এক ঝাঁক পোকা। কালী পুজোর সময়টার এই সব শ্যামা পোকাদের দৌড়াত্য, চোখে-মুখে ঢুকে যাওয়া একেবারে বিরক্তি যে জাগাত না, এমন তো নয়। তবু তাঁদের অনুপস্থিতি, বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়া তাহলে আজ এত কেন ভাবাচ্ছে আমাদের? কারণ আছে, তাই।
বিগত কয়েকটা বছর ধরেই কমে আসছিল শ্যামা পোকাদের বাড়বাড়ন্ত। তবু, গোটা হেমন্তজুড়ে না হলেও সপ্তাহ খানেকের জন্য, অন্তত কালি পুজোর সপ্তাহটায় দেখা যেত। সেই থেকেই তো গ্রিন লিফহপারের চলতি নাম হয়েছিল শ্যামা পোকা। কালী পুজো পেরিয়ে এবার ভরা হেমন্তেও দেখা মিলল না তাদের। প্রথম প্রথম সেই নিয়ে খানিক মিম বিনিময় হলো নেটপাড়ায়। পাশাপাশি উদ্বেগও বাড়ল।
গ্রিন লিফফপার মূলত ধান চাষের জমিতেই বেশি দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশেই পাওয়া যায়। এদের প্রধান খাবার হল ধানগাছের রস। ধানের ক্ষতি করে বলে চাষের সময় প্রচুর পরিমাণে কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয়, তার প্রভাবেই কি হারিয়ে যাচ্ছে শ্যামা পোকারা?
নাহ, বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনও একটা বড় কারণ। খুব আর্দ্র পরিবেশ ছাড়া শ্যামাপোকা বাঁচতে পারে না। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি কম স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ায় শুষ্ক আবহাওয়া, এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ক্রমেই কমছে নেফোটেট্টিক্স ভিরেসেনস-এর সংখ্যা। হ্যাঁ, আমরা যাকে শ্যামা পোকা বলে চিনি, তার বিজ্ঞানসম্মত নামটা এমনই খটমট।
কৃষিবিজ্ঞানীরা আরও মনে করছেন, কলকাতার আশপাশে ধানচাষ কমে যাওয়ার কারণেও কিন্তু এই পোকার সংখ্যা কমছে। ফলে, সার্বিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর কিন্তু তার নেতিবাচক প্রভাবই পড়ছে।
এটা তো গেল একেবারে স্থানীয় এক উদাহরণ। জলবায়ুর বদলে যাওয়া যে আরও কতো মারাত্মক হয়ে উঠছে, তার ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ রয়েছে, আমাদের পাশেই। পাহাড়ের রানি, কুইন অফ হিলস হিসেবে পরিচিত, ঘরের কাছের দার্জিলিং-এ তুষারপাত হয়নি বিগত বেশ কয়েক বছর। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে দার্জিলিং-এর তাপমাত্রা। উত্তর ভারতের শৈল শহর, ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মাকালীন রাজধানী ছিল, যে সুন্দরী সিমলা, সেখানেও চলতি বছরে ঘরে ঘরে ফ্যান কেনার হিড়িক পড়ে ছিল। আরও একটু উত্তরে যাই? ভূস্বর্গের কথা বলি একটু? দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এসেছিলেন কাশ্মীরের গুলমার্গে। চরম হতাশ হয়েছিলেন। চলতি বছরের কথাই তো। জানুয়ারির মাঝামাঝি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তুষারপাত হয়নি সেখানে। পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, জানিয়েছিলেন, সবই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল, আগামী বছরগুলোয় বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
বিদেশের ছবিটাও একটু দেখানো দরকার। একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। জাপানের। সে দেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম মাউন্ট ফুজিয়ামা, আসলে একটি আগ্নেয়গিরিও বটে। ছবির মতো সুন্দর সেই মাউন্ট ফুজিকে আলাদা করে চেনা যায় মাথার ওপরের ওই বরফের অংশটার জন্য। সেই বরফের টুপি উধাও। নভেম্বর মাস চলছে, এতদিনে চেনা চেহারায় ফিরে আসার কথা মাউন্ট ফুজির। কিন্তু কোথায় কী! বিগত কয়েক সপ্তাহে সূর্যোদয়ের দেশে নাকি রেকর্ড গরম পড়েছে, সে কারণেই ১৩০ বছরে প্রথম ঘটল এই অঘটন! অক্টোবরজুড়ে মাউন্ট ফুজির তাপমাত্রা থাকার কথা হিমাঙ্কের নীচে। বছরের এই সময়ে সেখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর সে জায়গায় তাপমাত্রা ১.৬ ডিগ্রি! একটা গোটা দেশের নামের সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে সমার্থক হয়ে উঠেছে ফুজিয়ামার মাথার ওই বরফের টুপি। সেই টুপিই গায়েব!
মাস চারেক আগে পৃথিবীর শুষ্কতম মরুভূমিতে ঘটেছিল এরকম আরেক অঘটন। চিলির আতাকামা মরুভূমিজুড়ে যেন বসেছিল বেগুণি ফুলের মেলা!। যে দিকে দু'চোখ যায় ফুলের গালিচা বিছোনো। এমনি সময়ে ফুলের গাছগুলি কোনওরকমে বেঁচে থাকে, দেখলে মনে হয় মরেই গেছে। সঠিক তাপমাত্রা আর বৃষ্টি হলে গাছে ফুল ধরে, তখন মাইলের পর মাইল মরুভূমিতে ফুটে থাকে বেগুণি ফুল। সেই দৃশ্য রচনা করেছিল এক দারুণ নিসর্গ, তবে আর সকলের মতো পরিবেশবিদরাও খুশি হতে পারেননি, তাঁদের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। জানিয়েছিলেন জলবায়ুর বদলে যাওয়ার ফলেই এমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। আতাকামায় এল নিনোর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণেই মরুভূমির শুষ্ক প্রান্তর বদলে গেল ফুলের গালিচায়।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং (Global Warming ) অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্রমশ সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, হিমবাহ গলছে, তাপমাত্রার পারদ চড়ছে একটু একটু করে, এই সংক্রান্ত নিত্য নতুন পরিসংখ্যান সামনে আসছে। এবার নাকি গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর দিন শেষ, সামনে আসতে চলেছে আরও কঠিন পরিস্থিতি । বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগ পার করে এবার পৃথিবী প্রবেশ করেছে গ্লোবাল বয়েলিং (Global Boiling) যুগে. সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, উত্তর গোলার্ধে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল ছিল উষ্ণতম। কত বছরের মধ্যে উষ্ণতম? ২০০০ বছরের মধ্যে!
বিপুলা এ পৃথিবীতে যেখানে যেখানে প্রাণের সঞ্চার, তার সবটুকু নিয়েই জৈব বৈচিত্র, সেই জৈব বৈচিত্রের সঙ্গে পাহাড়, নদি, মরুভুমি, জঙ্গল , সবটুকু নিয়ে আমাদের পরিবেশ। পরিবেশ দুষণের প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর, কঠিন অসুখ গ্রাস করছে আমাদের শরীর, মন। আর সারা পৃথিবীর কত লক্ষ কোটি প্রাণ নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের মতো।
মানুষ ছাড়া এই পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ বাঁচল, না হারিয়ে গেল, কিম্বা গোটা প্রজাতিই বিলীন হয়ে গেল, তা নিয়ে আমরা উদাসীন। যে প্রাণকে দেখতেই পাইনা, অথবা নাম জানি না, কিম্বা নাম জানি, কিন্তু আমার কাজে আসে না, তাঁর বেঁচে থাকা, না থাকা নিয়ে মাথা ঘামাবই বা কেন? ঘামাব, ঘামাতে হবে, কারণ, পৃথিবীর জৈব বৈচিত্র নষ্ট হলে তাঁর আঁচ কিন্তু একটু একটু করে আমাদের ওপরেই এসে পড়বে, এই মানব সভ্যতার ওপর। আর ঠিক সে কারণেই শ্যামা পোকাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে শুধু নস্ট্যালজিয়া আক্রান্ত হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্মৃতি রোমন্থন করে, দায়টা ঝেরে না ফেলে আর একটু সচেতন, আর একটু দায়িত্ববান হই আমরা? পরিবেশের, এই বাস্তুতন্ত্রের যত্ন নিই, অন্তত মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্যে হলেও?