হেমন্ত। শরতের শেষ হয়ে আসা, আর হামাগুড়ি দেওয়া শীতের মাঝে ক্ষণস্থায়ী যে ঋতু, সেই হেমন্ত বড় প্রিয় ছিল কবি জীবনানন্দ দাশের। তাঁর কবিতাজুড়েই ফিরে ফিরে আসত কার্তিকের রাত, গভীর অঘ্রান, কিছুটা কুয়াশা, কিছুটা মৃত্যু, কিছু বিষণ্ণতা। আচ্ছা, হেমন্তেই কেন সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে মৃত্যুর কথা? কেন মনে পড়ে দেখা, না দেখা মৃতজনদের?
প্রাচ্য এবং পশ্চিমী দুই সংস্কৃতিতেই হেমন্ত এবং অতীতের সম্পর্ক গাঢ়। আমাদের হেমন্তই ওদের ফল বা অটম। আর মৃতজনদের স্মরণ তো আসলে অতীতকে স্মরণ। অতীত অর্থাৎ ভূতকাল।
হিন্দু পুরাণ মতে পূর্ব পুরুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শুরু হয় মহালয়ায়। দীপাবলি পর্যন্ত নিবিড় যোগ থাকে বর্তমান আর অতীতের। কার্তিকের অমাবস্যা তিথিতে হয় কালীপূজা। কোজাগরী পূর্ণিমার কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীকে বলে ভূত চতুর্দশী। ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে ১৪ প্রদীপ। এই দিনে চোদ্দ রকমের শাক খাওয়ার চল রয়েছে হিন্দু ঘরে। চোদ্দ শাক, চোদ্দ প্রদীপ, হঠাৎ চোদ্দ কেন? কারণ, হিন্দু শাস্ত্রে ১৪ পুরুষের উল্লেখ রয়েছে। তাঁদের জন্য প্রদীপ কেন জ্বালাতে হবে? প্রচলিত বিশ্বাস, চতুর্দশী তিথির ভরা অমাবস্যায় চারিদিক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অন্ধকারে যেন পথ ভুল না হয়, তাই পূর্বপুরুষদের জন্য প্রদীপ জ্বালিয়ে অপেক্ষা। পশ্চিমের ‘হ্যালোউইন’ প্রথার সঙ্গে অনেকাংশেই মেলে এই আচার।
ভূত চতুর্দশীর দিন চোদ্দ শাক খাওয়ার পেছনেও পৌরাণিক গল্প রয়েছে। হিন্দু পুরাণ বলে, মৃত্যুর পর শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। পঞ্চভূত অর্থাত্ মাটি, জল, বাতাস, অগ্নি ও আকাশ। মনে করা হয়, মাটি থেকে তুলে আনা সমস্ত রকম শাক-সবজি খেলে আত্মারা তৃপ্ত হন।
আবার কালী পুজোর দিন দুয়েক পর যে ভাইফোঁটা, দেশের কোনও প্রান্তে ভাতৃ দ্বিতীয়া, কোথাও ভাই দুজ, তো আসলে যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার উদযাপন। যম তো মৃত্যুর দেবতা। সেই দেবতাকে তুষ্ট করে ভাইয়ের অমরত্ব কামনার পুজো।
আশ্বিনের অমাবস্যায় মহালয়ার দিন পূর্ব পুরুষকে স্মরণ করার রীতি রেওয়াজকেই বলে তর্পণ। মনে করা হয়, পরবর্তী একটা মাস মৃত পূর্ব পুরুষেরা ধরাধামে এসে কাটিয়ে যান আমাদের সঙ্গে। আনন্দ উৎসব উদযাপনে শামিল হন ক’টা দিন। কালী পূজার অমাবস্যায় তাঁদের পরলোকে ফিরে যাওয়ার পালা। কোজাগরী পূর্ণিমার পর চাঁদ ছোট হয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে অমাবস্যা। ঘোর অন্ধকারে কে পথ দেখাবে তাঁদের? তাই তো কার্তিক মাসজুড়ে আকাশ প্রদীপ জ্বেলে রাখার চল ছিল রাতভর। এই সংস্কৃতিতে বারবার ফিরে এসেছে অতীত মানে স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। প্রাচ্য দর্শণে স্মৃতির স্মরণ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ তো গেল আমাদের দেশের কথা। সুদূর মেক্সিকো তে ২ নভেম্বর পালিত হয় এল দিয়া দ্যা লস মুয়েরতস, চলিত ভাষায় এর অর্থ ডে অফ দ্য ডেডস। মৃত পূর্ব পুরুষের উদ্দেশে এই দিন উদযাপন। খ্রিষ্ট ধর্মের জন্মের অনেক আগে থেকে উদযাপিত হত এই অনুষ্ঠান। নানা রঙের পোশাকে আসলে আত্মার নানা রূপ তুলে ধরা হয় এই উৎসবে। প্রচলিত বিশ্বাস, আত্মারা এই সময় প্রিয়জনদের ঘরেই থেকে যান। তাই ঘরের বাইরে ফেলে ছড়িয়ে রাখা হয়, খাবার, পানীয়, নানা উপহার।
ব্রাজিলে ২ নভেম্বর দিনটি উদযাপিত হয় দিয়া দে ফিনাদোস হিসেবে। কাছের মানুষ, প্রিয়জন, যারা আজ পৃথিবীতে নেই, যারা গত হয়েছেন, তাঁদের স্মরণেই একটা গোটা দিন। ব্রাজিলে এই দিন ছুটি থাকে সব।
আবারও সেই ২ নভেম্বর। সেই একই দিন রোম্যান ক্যাথলিক মতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটায় পালন করেন 'অল সোলস ডে'। পরিবারের সদস্য অথবা নিকটাত্মীয়, যাদের সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটেছে, দিনটিতে তাঁদের স্মরণ করা হয়। কলকাতার একাধিক সমাধিতে এই দিনে জ্বলে ওঠে শয়ে শয়ে প্রদীপ। ওদের বিশ্বাস, মৃত আত্মারা জীবিতের জন্য প্রার্থনা করতে পারে, শুধু নিজেদের জন্য পারে না। তাহলে ওঁদের জন্য প্রার্থনা করবে কে? ওঁদের ভাল চাইবে কে? সে কথা মনে করেই বিশেষ বিশেষ দিনে আলো জ্বেলে রাখা, প্রার্থনা, হেমন্তের সব আয়োজন।
২ হাজার বছর আগে রোমানদের মধ্যেও একটা উৎসবের প্রচলন ছিল-'লেমুরিয়া'। মৃতজনেদের কবরে গিয়ে কেক এবং ওয়াইন ভাগ করে নিতেন রোমানরা। পেগান ধর্মের এই রীতিই পরে আপন করে নেন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা।
ইয়োরোপ আমেরিকায় ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হ্যালোউইন। এখন প্রায় সারা বিশ্বেই ৩১ অক্টোবর উদযাপিত হয় হ্যালোউইন ইভ। প্রাচীন কেল্টিক এক উৎসব থেকেই এসেছে হ্যালোউইন উদযাপনের চল। ৩১ অক্টোবর কেল্টিক ক্যালেন্ডারের শেষ দিন। কেল্টরা বিশ্বাস করেন এই রাতে, জীবিত এবং মৃতদের মধ্যে আর কোনও বেড়া থাকে না। হ্যালোউইন অর্থ পবিত্র রাত। সময়ের সাথে সাথে, হ্যালোইন উদযাপনের ধরণ বদলেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বেই একটু লঘু মেজাজে, মজাদার ভাবে পালিত হয় হ্যালোউইন। আট থেকে আশি, সকলেই হ্যালোউইন থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে 'ভূতের সাজ' সাজেন হ্যালোউইন পার্টিতে। কেল্টিক সংস্কৃতির হ্যালোউইন-এর সঙ্গে অবশ্য বেশ ফারাক রয়েছে হিন্দু ধর্মের ভূত চতুর্দশীর। হ্যালোউইনের ধারণায় 'ভূত' অর্থ অশুভ আত্মা। অশুভ অতৃপ্ত আত্মা তাড়ানোর উৎসব হল হ্যালোউইন।
সারা পৃথিবীতে হেমন্তেই কেন মৃতদের স্মরণ করা হয়, সেও এক আশ্চর্য বিষয় বটে। কেন এই সময়েই জীবিত এবং মৃতের মধ্যে দূরত্বটা কমতে কমতে একটা সুতোর মতো হয়ে ওঠে?
লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, সব অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাসেই রয়েছে এক অতীতের ফিরে ফিরে আসা। সব সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস, এই সময়ে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ঘুরে ফিরে বেরান আমাদের মাঝেই।
প্রাচ্যের মার্কন্ডেয় পুরাণ বলে পিত্রু অর্থাৎ পূর্ব পুরুষ তাঁর শ্রাদ্ধাচারে সন্তুষ্ট হয়ে উত্তরসূরির দীর্ঘায়ু, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সমৃদ্ধি কামনা করেন। আবার পাশ্চাত্যের ফরাসী ঔপন্যাসিক মারগুয়েরিট ইওরসেনার বলেছিলেন, "পূর্বপুরুষদের স্মরণের এই অনুষ্ঠান পৃথিবীর আদিতম উদযাপন। শস্য তোলা হয়ে গেলে ফাঁকা ফসলবিহীন মাঠে আত্মারা শুয়ে থাকেন, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়ে হয় স্মৃতির উদযাপন। প্রাচ্যেও তো ঠিক তেমনই হয়। হেমন্তেই হয় নবান্ন। নতুন ধান তোলা হয়ে গেলে মাঠ ফাঁকা। ফসলবিহীন সেই খাঁ খাঁ মাঠে আল বেয়ে সন্ধের মতো নেমে আসে অতীত। যত্ন নেয় এই সময়ের, বর্তমানের। বদলে, কী পায় অতীত? প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা, কাঁসার পাত্রে রাখা জল আসলে মনে করিয়ে দেওয়া, অতীত ভুলিনি। এখানে অতীত মানে প্রিয়জন, অতীত মানে ফেলে আসা ঘর, অতীত মানে নিজের শিকড়। শিকড় যত পোক্ত হবে, মাটির গভীরে যাবে যতো, ডাল পালা মেলে গাছও ছড়িয়ে পড়বে ততো, বনস্পতির ছায়া দেবে সারা জীবন।