সিনেমার নাম - বিনোদিনী : এক নটীর উপাখ্যান
পরিচালক- রামকমল মুখোপাধ্যায়
অভিনেতা - রুক্মিণী মৈত্র, কৌশিক গঙ্গোপাধ্য়ায়, মীর আফসার আলি, ওম সাহানি,রাহুল
মীরের 'থিয়েটার' সংলাপ দিয়ে শুরু
উনিশ শতকের কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী গুরমুখ রাই একদিন এই প্রশ্নটাই করেছিলেন বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের রানি বিনোদিনী-কে । ছলছলে চোখ, আর তাতে উথলে ওঠা স্বপ্ন, অনেক বেদনা নিয়ে বিনোদিনী উত্তর দিয়েছিলেন...'মেরি জান বাসতি হ্যায়'(audio) । থিয়েটারের জন্য বেঁচেছিলেন বিনোদিনী । মন, শরীর সব বিসর্জন দিয়েছিলেন থিয়েটারের জন্য । বদলে কী পেলেন, কতটা পেলেন,কতটা হারালেন...বলা ভাল বিনোদিনীর জীবনকে, তাঁর লড়াইকেই ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে বড়পর্দায় তুলে ধরলেন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায় । অনেকেই এতদিনে বিনোদিনী : নটীর উপাখ্যান দেখে ফেলেছেন । যাঁরা দেখেননি, আজকের ভিডিওটা তাঁদের জন্য...
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস যাঁরা পড়েছেন, সিনেমাটি তাঁরা খুব রিলেট করতে পারবেন । ব্রিটিশ শাসন, উনিশ শতকের সেই বাবু কালচার, রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের 'বারাঙ্গনা'-র চোখে দেখা, এছাড়া, নারীদের অস্তিত্ব যে তখন শুধু চিকের আড়ালেই ছিল, সেইসময়কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সিনেমায় ।
বিনোদিনী : এক নটীর উপাখ্যান । সিনেমার শুরুই হচ্ছে বৃদ্ধা বিনোদিনীকে দিয়ে । কোনও এক মন্দিরে ঘোমটার আড়ালে বিনোদিনীর হাতে পুরোহিত তুলে দিচ্ছেন প্রসাদ । তারপরেই বিনোদিনীর ছোটবেলায় নিয়ে যাচ্ছেন পরিচালক ।
১৫৪ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট। পতিতা বস্তিতে বেড়ে ওঠা বিনুর । সবাই তাঁকে ডাকত পুঁটি বলে । ছোট থেকে নাটক, থিয়েটার দেখতে খুব ভালবাসে পুঁটি ।প্রতিটা চরিত্রের পাঠ তার মুখস্থ । পুঁটি স্বপ্ন দেখত, একদিন মঞ্চে সেও অভিনয় করছে, পাঠ বলছে । কিন্তু, সমাজ যে তাকে বারবার ঠেলে দিতে চেয়েছে পতিতাবৃত্তির দিকে । কিন্তু, পুঁটি বারবার তাঁর গোলাপকে বলেছে, সে এই কাজ করবে না । অভিনয় করবে । সুযোগ এল । সীতার চরিত্রে পাঠ । আর সেই থেকেই শুরু হল পুঁটি থেকে বিনোদিনী হয়ে ওঠার লড়াই ।
শুধু বাঙালি বাবু বা নাট্যকার বা নাট্য পরিচালক নয়, বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলেন সাহেবরাও । একদিন গিরিশচন্দ্র ঘোষের চোখে পড়লেন বিনোদিনী । তারপর শুরু হল তালিম, অভিনয়ের তালিম, নাচের তালিম । হাতে কলম নিলেন বিনোদিনী । ওয়েস্টার্ন পোশাক পরা থেকে হাঁটা-চলা...নিজের হাতে বিনু-কে তৈরি করলেন মাস্টারমশাই গিরিশ ।
‘সীতার বিবাহ’ থেকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সরোজিনী’, ‘নীলদর্পণ...একে একে থিয়েটারে মঞ্চস্থ হতে শুরু করল । বিনোদিনীর অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে । সব শো হাউজফুল । বিনোদিনী শুধু একজন অভিনেত্রী ছিলেন না । নারী স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করেছেন । ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, সাহেবদের গালে চড় কষাতে এতটুকু হাত কাঁপেনি মহিয়ষী, বীরাঙ্গনা বিনোদিনীর । গ্রেফতার হয়েছেন । কিন্তু, মানসকন্যা বিনুর যে বারবার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ । আর আরেকজন ব্যক্তি রাঙা বাবু ।
কুমার বাবুর প্রেমে পড়েছিলেন বিনোদ । নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন ভালবাসার মানুষের কাছে । কুমার বাবুর বাড়ির লক্ষ্মী হতে চেয়েছিলেন । কিন্তু, বিনোদের মতো মেয়েদের যে সমাজ মেনে নেয় না । যতই পতিতাবৃত্তিকে দূরে ঠেলে স্বপ্নের পথে এগোতে চেয়েছিলেন বিনোদিনী, তাঁকে সমাজ বারবার 'বারাঙ্গনা' রূপেই দেখেছে । গুরমুখ বাবুকে স্পষ্ট বলেছিলেন, 'বিনোদিনী বিকাও না' ।
থিয়েটার ছাড়া কিছুই ভাবতেন না বিনোদিনী । তাঁকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তাঁর নামে থিয়েটার হবে । স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন গিরিশ ঘোষ । সেই স্বপ্নে ভেসে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন গুরমুখের কাছে । বদলে কী মিলল ? প্রতারণা !
বিনোদিনীর জীবনে টুকরো টুকরো কাহিনি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে গোটা চিত্রনাট্য ।
অভিনয়
বিনোদিনীর চরিত্রে রুক্মিণীর অভিনয় অনবদ্য । তিনি যে সত্যিই বিনোদিনীকে অনুভব করেছেন, তা গোটা সিনেমা দেখলেই বোঝা যাবে । বিশেষ করে নিমাই রূপে রুক্মিণী অভিনয়, দু'হাত তুলে নাচ...দেখে মনে হবে যেন সত্যিই নিমাইকে দেখছি । তারপর রামকৃষ্ণের এন্ট্রি । দৃশ্যটা দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে । চোখে জল এনে দেবে ।
এছাড়া, গিরিশচন্দ্রের ভূমিকায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে কিছু বলা মানে ধৃষ্টতা । এছাড়া, রাহুল বোস, ওম অভিনয়ে একে অপরকে টেক্কা দিয়েছে । সিনেমায় নজর কেড়েছে গোলাপের চরিত্র । অভিনয় করেছেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ । মীর, গৌতম হালদারও অনবদ্য ।
সিনেমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি গান ভাবা হয়েছে, হরি মন মজায়ে থেকে কানহা...আপনার কানকে আরাম দেবে । তবে, কিছু কিছু দৃশ্যে অতি নাটকীয়তা রয়েছে । তবে, সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে, রুক্মিণী, এটা বলতেই হয় ।
সিনেমা রুক্মিণীকে বিনোদিনী রূপে কাস্ট করা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি রামকমলকে । কিন্তু, রুক্মিণীতে বিশ্বাস রেখেছিলেন । সেই বিশ্বাসেই জয়ী হয়েছেন নায়িকা । এক নটী সর্বোপরি এক নারীর কথা বলতে পেরেছেন রামকমল । নারী স্বাধীনতা নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন । আর সব সমালোচনার জবাব দিয়ে রুক্মিণী বলতে পেরেছেন, 'আমি নারী, আমিও পারি ।'
সম্প্রতি, মুম্বইয়ে স্ক্রিনিংও হয়ে গিয়েছে 'বিনোদিনী : এক নটীর উপাখ্যান'-এর । সিনেমা নিয়ে ভাল প্রতিক্রিয়াও পাচ্ছেন । এক সপ্তাহের হিসেবে ৬০ লাখের কাছাকাছি আয় করেছে এই সিনেমা ।
সেদিন, বি থিয়েটারের স্বপ্ন পূরণ হয়নি বিনোদিনীর । তবে, সেই স্বপ্নটা হয়তো নতুন করে দেখেছিলেন রামকমল ও রুক্মিণী । ১৪১ বছর পর স্বপ্নটা পূরণ হল । সার্থক হল বিনোদিনীর লড়াই । বিনোদিনী সিনেমার পুরো টিমের লড়াই । বিনোদিনী থিয়েটারে বসে বিনোদিনীর লড়াইকে দেখলেন দর্শকরা, বিনোদিনীকে চিনলেন, এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে, আর এখানেই কোথাও জিতে গেলেন রামকমল মুখোপাধ্যায় ।
