চারপাশে সবুজের গালিচা । মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে নুড়ি-পাথরের রাস্তা । দু'দিকে শুধু গাছের সারি । পাশ দিয়েই নীরবে বয়ে চলেছে ছোট্ট হলং নদী । আর তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কাঠের একটি সবুজ বাংলো । ভোর হলেই পাখির কলতান, রাতের বেলায় ভেসে আসে ঝিঝির ডাক । কখনও চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বাইসন, হাতি, হরিণের পালকে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সান্নিধ্যে থাকার সেরা ঠিকানা হলং বন বাংলো । জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের ঐতিহ্য । ডুয়ার্স যাবেন, অথচ হলং বাংলোতে যাবেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম । কিন্তু, আজ সেই বাংলোর ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা । মঙ্গলবার রাতে বিধ্বংসী আগুনে জ্বলে ছাই গিয়েছে হলং বাংলোটি । কোথায় সেই সবুজ, চারপাশে শুধু কালো ছাই আর পোড়া গন্ধ ।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ আগুন লাগে বলে খবর । আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দমকলের তিনটি ইঞ্জিন মাদারিহাট থেকে যায়। কিন্তু ততক্ষণে দাউ দাউ করে জ্বলে গিয়েছে গোটা বাংলো । কীভাবে আগুন লাগল ? বন দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলোর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ইলেক্ট্রিক বক্স থেকে শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগে । প্রথমে কর্মীরাই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সাহায্যে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। সেইসময় এসিতেও আগুন লেগে যায়। এসি-তে যে গ্যাস থাকে, তা থেকে সম্ভবত বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুন । যার জেরে প্রায় গোটা বাংলো আগুনের গ্রাসে চলে গিয়েছে । বর্ষার সময় জলদাপাড়া বন্ধ থাকায় কোনও পর্যটক ছিলেন না । তাই হতাহতের খবর নেই । তবে, বাংলো পুড়ে যাওয়ায় কয়েক কোটির ক্ষতি হয়ে গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে । বড় ক্ষতির সম্মুখীন ব্যবসায়ীরা ।
হলং বাংলো সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য
১৯৬৭ সালে মাদারিহাটে জলদাপাড়া জঙ্গলের ভিতর এই বনবাংলোটি তৈরি হয় । ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিজ্যম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এই বাংলোটির পরিচালনা করতেন । রাজ্য বন দফতরের অন্যতম মূল্যবান ও ঐতিহ্যবাহী বাংলো এটি । নীরবতায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে, জঙ্গলের রোমাঞ্চ উপভোগ করতে করতে কটা দিন কাটানোর জন্য দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসতেন এই বাংলোয় । ভিআইপি থেকে সাধারণ পর্যটক...প্রত্যেকের জন্যই রাত্রিবাসের দারুণ ব্যবস্থা ছিল এই বাংলোয় । আটটি সুসজ্জিত থাকার ঘর রয়েছে। তার মধ্যে দুইটি ঘর বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিশেষ অতিথিদের জন্য। কিন্তু, আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে ।
বনবাংলো থেকে ৩০ মিটার দূরত্বে আধিকারিক ও বনকর্মীদের কোয়ার্টার। কিছুটা দূরেই রয়েছে হাতি পিলখানা । হলং থেকে সহজেই জলদাপাড়া এলিফ্যান্ট সাফারি করা যায়।
জানেন কি, প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব পছন্দের জায়গা ছিল হলং বনবাংলো। অনেক সময়েই ছুটি কাটাতে সপরিবারে চলে আসতেন এখানে । সুযোগ পেলেই বাংলায় গিয়ে উঠতেন । পুজোর ছুটিতে বেশ কয়েকবার গভীর জঙ্গলে ঘেরা ওই বাংলোয় কাটিয়েছিলেন তিনি । হলং নদীর ছোট বোরোলি মাছ ছিল জ্যোতিবাবুর পছন্দের খাবার । এখানে এলেই বোরোলি মাছের পাতলা ঝোল, কাঁচা চচ্চড়ি বাধাধরা ছিল ।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও পা রেখেছেন এই বাংলোয় । বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঘুরে গিয়েছেন এই বাংলোতে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছেন তাঁরা ।
ঐতিহ্যবাহী বাংলোয় আগুন লাগা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে । বর্ষার কারণে ১৫ জুন থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বাংলা বন্ধ রাখা হয়। সেক্ষেত্রে বনবাংলোতে কোনও বুকিং ছিল না । তাহলে বাংলোয় এসি বা গিজার চলার কথা নয়, তাহলে শর্ট সার্কিট হলো কীভাবে? এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছেন বন দফতরের আধিকারিকরা।
হঠাৎ করে বাংলোটি পুড়ে যাওয়ায় হতাশ পর্যটকরা । ভেঙে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা । প্রতিবছর হলং বাংলোকে কেন্দ্র করে বড় অঙ্কের উপার্জন হয়ে থাকে । কিন্তু তা পুড়ে যাওয়ায় বড় ক্ষতি হয়ে গেল তাঁদের ।
হলং বাংলোকে পুরনো রূপে, পুরনো নামে ফিরিয়ে দিতে হবে । ইতিমধ্যেই এমনই দাবি উঠতে শুরু করেছে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ।