মল্ল রাজারা নেই, নেই তাঁদের রাজ্যপাট । তাঁদের গড় বিষ্ণুপুরে (Bishnupur Mallaraj Durga Puja) রয়ে গিয়েছে শত প্রাচীন ভাঙাচোরা রাজবাড়ি, যাঁর প্রতিটা ইটে রয়েছে কোনও গল্প । আর সেই গল্পের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2022) ইতিহাস ও পুজোর রীতি-নীতি । রাজ্যপাট না থাকলেও সেই রীতি-নীতি বজায় রয়েছে । প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে গেল বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দুর্গোৎসব (Bankura Mallaraj Durga Puja) । মল্ল রাজাদের পুজো প্রায় হাজার বছরের পুরনো ।
পুজোর প্রতিষ্ঠাকাল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ । তৎকালীন রাজা জগৎ মল্ল বিষ্ণুপুরে দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি মল্ল রাজাদের কূলদেবী । কথিত আছে,আজ যেখানে দেবীমূর্তির অবস্থান, সেখানেই একটি বটগাছের নিচে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মহারাজ । তখনই স্বপ্নে দেখা দেন মৃন্ময়ী । মন্দির প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন । এরপর রাজা জগৎমল্লের উদ্যোগেই তৈরি হয় মৃন্ময়ীর মন্দির । বিশাল জাঁকজমক, রাজকীয় সমারোহে আয়োজন শুরু হয় পুজোর । আজও পুরনো রীতি-নীতি মেনে পুজো হয়ে আসছে ।
'পট পুজো' এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও বড় ঠাকুরানি, মেজ ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানির আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন । মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয় । বড় ঠাকুরানি রূপে পূজিতা হন মহাকালী। মেজো ঠাকুরানি রূপে মহালক্ষ্মী ও ছোট ঠাকুরানি রূপে দেবী মহাস্বরস্বতী ।
পুজোর প্রথম দিন বড় ঠাকুরানির পুজো হয় । প্রথা মেনে এদিন থেকে শুরু হয়ে গেল বড় ঠাকুরানির পুজো । প্রথম দিন সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন রঘুনাথ সায়রে বড়ঠাকুরানির পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পর প্রথানুযায়ী মূর্চ্ছা পাহাড়ে তিন বার কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয় । পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তোপধ্বনি দেওয়া হয় । পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরও তিনবার কামানের তোপধ্বনি গর্জে ওঠে । সব মিলিয়ে ৯বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সূচনা হল পুজোর ।
প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর অষ্টমীর দিন থেকেই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্ট ধাতু নির্মীত বিশালাক্ষ্মী ও নবমীর রাতে খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয় । বিজয়া দশমীতে দেবী মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর বড় ঠাকুরানি, মেজ ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানির ঘট বিসর্জন হয় । সব শেষে এই তিন ঠাকুরানির পট রাজবাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে যাওয়া হয় । গঙ্গামাটিতে তৈরি এই মূর্তির বিসর্জন হয় না। স্বপ্নাদেশ পেলে অঙ্গরাগ বা রং করা হয়।
সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিনগুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে । প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় করেন । পুজোর ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছেন রাজ পরিবারের সদস্য়রা ।