বাতাসে বহিছে প্রেম…বসন্ত এসে গেছে। আর বসন্তের শুভ মহরৎ হয় কিন্তু সরস্বতী পুজোর হাত ধরেই। ম্যাচিং শাড়ি-পাঞ্জাবি, অঞ্জলি দিতে গিয়ে চোখাচুখি, সকাল থেকে উপোশ- এই দিনটাকে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ও বলা হয়। এই একটা দিন এক নিমেষে ফিরিয়ে দেয় স্কুলবেলার দিনগুলো। বাড়ির পুজো সেরে শাড়ি পরে ইস্কুলে ঢুঁ না দিলে আবার কীসের সরস্বতী পুজো!
তবে এবার পুজো কিন্তু একদিন নয় দুইদিন। রবিবার না সোমবার কোনদিন হবে পুজো এই নিয়ে স্কুলে স্কুলে তৈরি হয়েছে বেজায় বিভ্রান্তি। আসলে এবার তিথি পড়ে যাচ্ছে রবিবার থেকেই। সরস্বতী পুজো হয় শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে। গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা অনুসারে ১৯ মাঘ পঞ্চমী তিথি শুরু হচ্ছে দুপুর ১২ টা ১২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে। পঞ্চমী তিথি থাকছে পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ সোমবার সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড পর্যন্ত। কিন্তু পুরাণ মতে সূর্যোদয় দিয়েই তিথির শুরু হয়, তাই অনেক পুরোহিতের মতে পুজো করা উচিৎ সোমবারেই। একাধিক স্কুলে সুবিধার্থে পুজোর দিন হিসেবে রবিবার ঠিক করা হয়েছে। আর সোমবার পুজোয় বসতে হলে অনেক ভোর ভোর বসতে হবে।
তা পুজোর দিনক্ষণ তো জানা হল। ওই তিথি শেষ হওয়ার আগে কিন্তু মোটেও দাঁতে কাটা যাবে না কুল- এই বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু কেন এই কথা বলা হয়? সত্যিই কি পুজোর আগে কুল খেলে বিদ্যেধরী রুষ্ট হন? কেন এই বিশ্বাস?
প্রথমত একটা সামাজিক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। গ্রামেগঞ্জে বা গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ফল ভগবানকে না দেওয়া মুখে তোলা হয় না। শীতকালের ফল কুল, তাই বাগদেবীকে দিয়েই প্রসাদ হিসেবে খাওয়া হয় কুল।
রয়েছে একটা বৈজ্ঞানিক কারণও। শীতের অবসান এবং বসন্তের শুরুতে সরস্বতী পুজো হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে নানা রকমের অসুখ বিসুখ হয়, এছাড়া কাঁচা কুল খেলে পেট খারাপ হতে পারে। সেই কারণেও পুজোর আগে কুল খেতে বারণ করা হয়।
রয়েছে পুরাণের একটি কাহিনিও। দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করতে একবার মহামতি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে তপস্যা করেছিলেন। সরস্বতী সেখানে একটি কুলের বীজ রেখে এসেছিলেন এবং আদেশ দিয়েছিলেন। ওই বীজ থেকে গাছ হয়ে, ফল ধরার পর যতদিন না কুল ব্যাসদেবের মাথায় পড়বে ততদিন পর্যন্ত তপস্যারত থাকতে হবে তাঁকে। সেই মেনেই তপস্যা শুরু করেছিলেন ব্যাসদেব। কুল মাথায় পড়লে ব্যাসদেব চোখ খোলেন, সেদিনটা ছিল বসন্তপঞ্চমী। এই গল্প থেকেও বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
কেন সরস্বতীকে পলাশপ্রিয়া বলা হয়?
অন্যদিকে, দুর্গাপুজোর সঙ্গে যেমন কাশ-শিউলির সম্পর্ক, সরস্বতী পুজোর সঙ্গে তেমনটা পলাশ ফুলের। লাল পলাশ ছাড়া বিদ্যাদেবীর আরাধনা হয় না। অথচ সরস্বতী যে পদ্মাসনা। তাঁর পুজোয় কীভাবে পলাশ হয়ে উঠল এত গুরুত্বপূর্ণ?
বিদ্যার এবং সঙ্গীতের দেবী হিসেবে অনেক বেশি জনপ্রিয় হলেও সরস্বতী কিন্তু ঊর্বরতার প্রতীকও। ঋতুমতী নারীই গর্ভধারণে সমর্থ। পলাশ রক্তবর্ণ, তাই এই ফুল হয়ে উঠেছে প্রজননের প্রতীক। তাই লাল রঙের ফুলকেই কয়েক হাজার বছর ধরে সরস্বতীর চরণে নিবেদন করার চল। শ্বেতশুভ্রা দেবীর ‘পলাশপ্রিয়া’ হয়ে ওঠার পেছনে এটাই কারণ।
পুরুলিয়া বাঁকুড়া অঞ্চলের স্থানীয় জনজাতিদের মধ্যে আজও বিশ্বাস, পলাশ পাতা বন্ধ্যাত্ব দূর করে। সন্তান লাভের জন্য মেয়েরা পলাশপাতা বেটে খান আজও। এভাবেই ধর্মীয় আচার আর লোকজ বিশ্বাস একে অন্যকে জড়িয়ে থাকে যুগের পর যুগ।