আমাদের দেশ উৎসবের দেশ। এ দেশের মানুষও সমস্ত হাসি, কান্না, হেরে যাওয়া, জিতে যাওয়াকে সঙ্গে নিয়েই উৎসবমুখর। যে গুটিকয়েক উৎসবকে নিয়ে আদতে এক হয়ে যায় প্রায় গোটা ভারতবাসী, তার মধ্যে অন্যতম অনিবার্য নামটি হল ‘মকর সংক্রান্তি’ (Makar Sankranti) বা ‘পৌষ সংক্রান্তি’। আমবাঙালির কাছে এই উৎসব পিঠে, পুলি, মালপোয়ার। এই উৎসব নলেন গুড়ের। এই উৎসব সাগরমেলা ও কেঁদুলির জয়দেবের মেলারও।
আর বাকি ভারতবাসীর কাছে?
কোথাও কুম্ভমেলা তো কোথাও ‘লোহরি’। কোথাও ‘পোঙ্গল’ (Pongal) তো কোথাও এর নাম ‘মকর সংক্রমণ’ (Makar Sankraman)। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ তত্ত্বটি বঙ্গাব্দের পৌষ মাষের শেষলগ্নে যেভাবে দেশের প্রায় ঘরে ঘরে বিরাজ করতে শুরু করে উৎসবের আঙ্গিকে, তা দেখে এক প্রকার বিস্মিতই হতে হয়।
বাঙালির পিঠে পুলির মতই তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল উৎসবে হয় আখ ও তিলের মিষ্টি। রীতি অনুযায়ী, তামিলরা এই উৎসবের প্রথম দিনে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালান এবং সেই আগুনে পুরনো পোশাক সহ অন্যান্য জিনিসপত্র আহুতি দিয়ে দেন।
মণিপুরের বহু মানুষ এই সময় তাঁদের আরাধ্য ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করেন। আবার,উত্তর-পূর্বের আরেক রাজ্য অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের কাছে ব্রহ্মকুণ্ডে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার আরাধনা করা হয় মকর সংক্রান্তিতে।
পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে হয় লোহরি। উত্তর ভারতের হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা লোহরিকে শীতের শেষ বলে চিহ্নিত করেন। এই উৎসবকে সূর্যের উত্তরায়ণকে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য বলেও মনে করেন তাঁরা।
অসমে ভোগালি বিহু, এই বিহুকে ভোজনের উৎসব বলা হয়। এই বিহুর সময়ে অসমীয়রা পিঠে, নাড়ু ইত্যাদি প্রস্তুত করেন। কাশ্মীরে হয় ‘শায়েন-ক্রাত’ আর গুজরাতে এই উৎসবের নাম ‘উত্তরায়ণ’। ওড়িশার একাংশে আবার নাম ‘টুসু উৎসব’ (Tusu Utsav)।
মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং কেরালায় ‘মকর সংক্রান্তি’ (Makar Sankranti) নামটিই প্রচলিত হলেও স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে। বিহার, ঝাড়খন্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় ‘খিচড়ি পর্ব’ বা ‘সকরত’ও বলে।
পুরাণমতে, এই সময়েই ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আর, বিজ্ঞান বলছে, এই সময়েই শুরু হয় সূর্যের উত্তরায়ণ।
সব উৎসবই সূর্যের। সব উৎসবই, শেষমেশ আলোর। আর সেই আলোতেই পিঠে-পুলি-নাড়ু আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মিলেমিশে থেকে যায় ঐতিহ্যের ভারতবর্ষ।