Patachitra village Pingla: রঙিন গ্রামে 'পটের মায়া', ইতিহাস, সংস্কৃতির সেতুবন্ধে উপচে পড়ছে পর্যটকদের ভিড়

আপনি নিশ্চয়ই ভ্রমণপিপাসু ? তা যদি হয় তাহলে বাংলার মেঠো পথ ধরে গ্রামে গ্রামে ঘোরার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু বাংলায় এমন গ্রাম বোধহয় আপনি দেখেননি। যে গ্রামকে রঙিন গ্রাম বললেও বোধহয় ভুল হবে না। কারণ একসঙ্গে এত রঙ বোধহয় আজকাল খুব কমই চোখে পড়ে। কোথায় এই গ্রাম? ছোট্ট এই গ্রামের হদিশ পেতে গেলে আমাদের পৌঁছে যেতে হবে কলকাতা থেকে মাত্র ১১৭ কিলোমিটার দূরের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর। এই জেলাতেই রয়েছে আমাদের রাজ্যের একমাত্র পট গ্রাম।

পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের নয়াগ্রাম। যে গ্রামের প্রতিটা বাড়ির দেওয়াল বলে রঙিন, বর্ণময় বাংলার ইতিহাস, পুরাণ এবং সংস্কৃতির গল্প। ফলে, বাংলার হারিয়ে যাওয়া পটশিল্পের হদিশ পেতে এই শীতে আপনাকে একবার ঢুঁ মেরে আসতেই হবে পটের গ্রাম নয়াগ্রামে। যে গ্রামের প্রত্যেকেই 'চিত্রকর'। তাঁরা ছবি আঁকেন আবার গানও বাঁধেন। আর সেই গানই তাঁদের হাতের জাদুতে ফুটে ওঠে পটচিত্রে। অনেকেই মনে করেন, এই গ্রামের পটুয়ারা আসলে স্বয়ং বিশ্বকর্মার বংশধর।

কী এই পটচিত্র?

'পট' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'পট্ট' থেকে। যার অর্থ কাপড়। যা শুনেই বোঝাই যাচ্ছে কাপড়ের উপরে আঁকা চিত্রকেই পটচিত্র বলে। এই পটচিত্র প্রাচীন বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাঁদেরকে পটুয়া বলা হয়।

এই পটচিত্র মূলত উজ্জ্বল রঙের ছবি। আর এই ছবির প্রাচীন কাহিনীগুলো সহজ সুরের গানের মাধ্যমে সকলের সামনে পরিবেশন করাই হল এই শিল্পের মূল লক্ষ্য। পটের গান এই পটচিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা এখনও পিংলার এই গোটা গ্রাম বাঁচিয়ে রেখেছে।

কাপড়ের উপর আঠা দিয়ে শক্ত কাগজ জুড়ে তৈরি হয় পট। এগুলি মূলত তিন ধরণের হয়। সাধারণত পটচিত্র ৩ থেকে ১০ ফুট কিংবা তারও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। কোনো ঘটনা বা কাহিনীর ধারাবাহিক বর্ণনা তুলে ধরা হয় এই পটে। আর পটুয়ারা এই পটের কাহিনিই গানের মাধ্যমে শোনান।

পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার এই পটশিল্পে মুগ্ধ নন, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সামদৃত এই পটশিল্প। পটুয়ারা পেশাদার শিল্পজাতি। যারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ছবি আঁকতেন ও সংগীত পরিবেশন করেন।

এক সময় এই পটগ্রামের বাসিন্দারা আশেপাশের এলাকায় পটের ছবি দেখিয়ে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কখনও তাঁরা গান ধরতেন চাঁদ সদাগরের কখনও আবার চণ্ডীমঙ্গলের। আর তাঁদের পটে ছবিতে আঁকা থাকত এই ধরনেরই পৌরাণিক কাহিনির সারাংশ।

শুধু আঁকায় নয়। এই শিল্পীদের রঙেও রয়েছে বিশেষত্ব। কারণ পটুয়ারা আঁকেন প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে। আর প্রাকৃতিক রঙ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় প্রাকৃতিক উপাদান। যেমন সবুজ রঙ তৈরি করতে ব্যবহার হয় গাছের পাতা। লাল রঙ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় খয়ের, চুন। নীল রঙের জন্য বেছে নেওয়া হয় অপরাজিতা ফুল। আর সাদা রঙ ব্যবহার করা হয় কুসুম নামক বিশেষ মাটি থেকে। যদিও এখন ফেব্রিকের ব্যবহার বেড়েছে।

বর্তমানে পটচিত্র আর থেমে নেই পৌরাণিক কাহিনীতে। এখন পটে আঁকা হয় নানা সামাজিক বিষয়, দুর্যোগ এমনকি ধর্ম সমন্বয়ের কথা। পটচিত্র এখন আর শুধু আটকে নেই কাপড়ের ক্যানভাসে। এখন পটচিত্র তুলে ধরা হয় শাড়ি, ওড়না, ব্যাগ, টি-শার্ট, কাঁসার থালা, ট্রে, কেটলি, ছাতা, কুলো, কাপ, প্লেটের মতো বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসে।

কোন সময় যাওয়া যায় এই গ্রামে?

এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে কর্মশালা। দিনরাত কাজ হয় প্রতিটি বাড়িতে। এমনকি এই গ্রামে কয়েকটি সংগ্রহশালা। যেখানে রয়েছে মুখোশ, মুদ্রা, পুঁথি এবং পট। নয়াগ্রামের অনেক বাড়িতেই রয়েছে হোম-স্টে চাইলে যে কোনও সময় এই গ্রামে যাওয়া যায়, থাকাও যায়। আবার একদিনের জন্য ঢুঁ মেরে আসা যায়। মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থাও রয়েছে।

তবে, এই গ্রামে প্রতি বছরই বিশেষ একটি মেলার আয়োজন করা হয়। সারাবছর পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকলেও এই মেলার দিনে ভিড় উপচে পড়ে। ২০০৯ সাল থেকে এই গ্রামে মেলা শুরু হয়। আগে এই মেলার আয়োজন করা হত ৩ দিনের। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০ দিনের। মোটামুটি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই মেলার আয়োজন করা হয়।

কী ভাবে যাবেন?

গাড়িতে যেতে চাইলে কলকাতা থেকে N.H - 6 ধরে ডেবরা পৌঁছবেন। আর সেখান থেকে বালিচক হয়ে সোজা পৌঁছে যাবেন পিংলার নয়াগ্রামে। আর ট্রেনে পৌঁছতে চাইলে হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বালিচক, সেখান থেকে বাস কিংবা ট্রেকারে চেপে পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। আর বাসে যেতে চাইলে কলকাতা থেকে খড়গপুরের বাসে করে ডেবরা। সেখান থেকে ময়নার বাসে উঠলেই পৌঁছে যেতে পারবেন এই রঙিন গ্রামে।