জীবনে ৯০ মিনিটের গুরুত্ব কতোটা, তা হাড়ে হাড়ে বোঝেন মেসি-রোনাল্ডোরা। তবে হালে ভারতীয়দের সব আলোচনা এসে ঠেকছে ৯০ ঘণ্টায়।
সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা! কীসের কথা বলছি, এখন আর আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। গুগলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ট্রেন্ডিং এই ৯০ ঘণ্টা। লারসেন অ্যান্ড টুবরোর চেয়ারম্যান এস এন সুব্রামনিয়াম বলেছেন, কর্মীদের সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা কাজ করা দরকার। L & T -তে শনি-রবিবার ঘোষিত ছুটি, কিন্তু অধিকাংশ কর্মীকে শনিবার কাজ করতে হয়, এই প্রসঙ্গে সুব্রামনিয়াম জানিয়েছেন, শুধু শনিবার কেন, রবিবারও যে তিনি কর্মীদের অফিসে আনতে পারছেন না সেই নিয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ রয়ছে তাঁর। সুব্রামনিয়াম আরও জানিয়েছিলেন, 'রবিবার মানুষ বাড়িতে বসে করেটা কী! নিজেদের স্ত্রীয়েদের দিকে তাকিয়ে কতোক্ষণ সময় কাটানো যায়?
এখানে প্রথমেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে! সুব্রামনিয়াম পুরো মন্তব্যটি করলেন তাঁর সংস্থার পুরুষদের উদ্দেশে। এল অ্যান্ড টি-র মতো একটি বহুজাতিক সংস্থায় মহিলা কর্মীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাহলে এমন মন্তব্য কেন? চেয়ারম্যান নিজে পুরুষ বলে? নাকি ওই পদে কোনও মহিলা থাকলেও এমন মন্তব্য করতেন? এর পেছনেও কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বড় ভূমিকা? সেই নিয়ে কিন্তু তর্ক, পাল্টা তর্ক চলতেই পারে।
সুব্রামনিয়ামের মন্তব্য ঝড় তুলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম থেকে রিল, টেলিভিশনে খবর, পাড়ায় পাড়ায় তর্ক-বিতর্ক-চর্চা সবই চলছে। এই প্রসঙ্গে একবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এল অ্যান্ড টি চেয়ারম্যান-ই কি প্রথম, যিনি এ ধরনের মন্তব্য করলেন? উত্তর, অবশ্যই না। ইনফোসিস প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির একটি মন্তব্য সাম্প্রতিক অতীতেই গোটা দেশজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়ছিল। তিনি কর্মীদের সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজের পক্ষে কথা বলেছিলেন।
সুব্রামনিয়ামের মন্তব্য কিন্তু সমর্থন করেননি দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের অনেকেই। প্রসঙ্গের উল্লেখ না করেই স্ত্রীয়ের প্রশংসা করে তাঁর সঙ্গে ছবি টুইট করেছেন আরপিএসজি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ডঃ সঞ্জীব গোয়েঙ্কা লেখেন, 'স্ত্রীয়ের চেয়ে দামি কেউ নয়। অনন্তকাল চেয়ে থাকতে পারি'। এল এন্ড টি-র ঘটনায় মহিন্দ্রা গোষ্ঠীর কর্ণধার আনন্দ মহিন্দ্রা বলেন, "আমার স্ত্রীকে এতওই সুন্দর, যে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমি খুব ভালবাসি"। তাছাড়া কাজের কোয়ান্টিটির চেয়ে কাজের কোয়ালিটির ওপর জোর দিতে বলেছেন আনন্দ মহিন্দ্রা। বলেছেন, চাইলে দশ ঘণ্টা কাজ করেই গোটা বিশ্বকে বদলে দেওয়া যায়।
নিজের ছবি টুইট করে আদর পুনাওয়ালাও লিখছেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবসেন তাঁর স্ত্রীও। আনন্দ মহিন্দ্রার মতো কাজের পরিমাণের চেয়ে কাজের গুণগত মানকেই বেশি গুরুত্ব দেন পুনাওয়লাও। স্ত্রীয়ের সঙ্গে রবিবার কাটানোর ছবি পোস্ট করছেন অনেকেই।
এবার একটু জেনে নেওয়া যাক সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা কাজ করা নিয়ে ভারতের লেবার ল এবং ফ্যাক্ট্রি আইন কী বলে? বলে, ভারতে দিনে বিরতি সহ একজন কর্মী সর্বোচ্চ ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা। এর পরে অতিরিক্ত কাজ করানো হলে, ওভারটাইম হিসেবে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে কর্মীকে।
কিন্তু, লেবার ল সবসময় কি মানা হচ্ছে সব রাজ্যে? কয়েক মাস আগেই ১৪ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব দিইয়েছে কর্নাটকের বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে স্বাস্থ্য ইস্যু ও ছাঁটাই প্রসঙ্গ তুলে সরব হয়েছেন সে সব সংস্থার কর্মীরা।
কর্নাটকের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির তরফে আইটি/আইটিইস/ বিপিওর কর্মীদের দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি অতিরিক্ত ২ ঘণ্টা ওভারটাইমের অনুমতি চেয়ে জানানো হয়ছিল কোনওভাবেই তা পর পর তিন মাসের নিরিখে ১২৫ ঘণ্টা অতিক্রম করবে না।
কর্নাটক স্টেট আইটি/আইটিইস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন তথা কিটুর তরফে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জানানো হয়েছে, আইটি সেক্টরের ৪৫ শতাংশ কর্মী অবসাদে ভুগছেন। ৫৫ শতাংশের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। ফলে কাজের সময় বাড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কর্মীদের যন্ত্র নয়, মানুষ হিসেবে দেখার আর্জিও জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে দেড় বছর আগেই সপ্তাহে তিনটে দিন ছুটি (three day weekend), চার দিন কাজ! এই ব্যবস্থায় ব্রিটেনে কাজের ট্রায়াল চলেছে টানা ছ'মাস। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। প্রথম দফার ট্রায়ালের ফলাফল বলছে, সপ্তাহে কাজের দিন কমিয়ে, ছুটির দিন তিন দিন করলে কর্মীদের থেকেও ভাল মানের কাজ পাচ্ছে সংস্থাগুলো। ৬১ টির মধ্যে ৫৬টি সংস্থায় এই সেট আপেই কাজ চালিয়ে যেতে চায়। কারণ, এই নতুন নিয়মে কাজ করার ফলে ৭১ শতাংশ কর্মীর স্ট্রেস কমেছে, কাজ নিয়ে সন্তুষ্টি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ কর্মীর। এ ছাড়া, উদ্বেগ, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যাও অনেক কমেছে কর্মীদের। সব মিলিয়ে মানসিক এবং শারীরিক সার্বিক উন্নতি হয়েছে।
পাশাপাশি, গত এক বছরে ভারতের বহু অফিসে কাজের সাংঘাতিক চাপে কর্মীর মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। পুনের ই অ্যান্ড ওয়াই-এর তরুণী কর্মী আন্না সেবাস্টিয়ানের মৃত্যুর খবর সামনে এসেছিল ২০২৪-এর মাঝামাঝি। দিন কয়েকের মধ্যে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় লখনউ-এর এইচডিএফসি ব্যাঙ্কে। অফিসে কাজ করতে করতে চেয়ার থেকে পড়ে মৃত্যু হয় ৪৫ বছরের সদফ ফতিমার।
দু'টি ঘটনা নিয়েই রাজনৈতিক মহলেও তোলপাড় হয়।
ভারতের অফিসের নেতিবাচক কর্ম সংস্কৃতি নিয়ে আগেও বিস্তর খবর সামনে এসেছে। মাসেই বেঙ্গালুরুর এক ঘটনা সামনে এসেছিল। অভিমানে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন বেঙ্গালুরুর ৩৭ বছরের অধ্যাপক, কারণ, নিজেকে উজার করে দেওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর বেতন বাড়ছিল না ইঞ্জিনিয়রিং কলেজের সহকারী অধ্যাপকের। হালে আবার ইপিএফ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠান। নিজের ইস্তফাপত্রটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে অধ্যাপক জানিয়েছিলেন, কেন চাকরি ছাড়ছেন, সেই প্রশ্নটুকু পর্যন্ত কেউ করল না তাঁকে।
দুর্ব্যবহার, ওভারটাইমের জন্য চাপ! বসের নির্দেশ শুনে প্রথম দিনেই ইস্তফা দেন ইঞ্জিনিয়র, মাস খানেক এরকম একটি খবর নিয়েও খুব আলোচনা হয়েছিল।
নতুন চাকরিতে প্রথম দিন। উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবেন, কাজ বুঝে নেবেন অল্প অল্প, তা না, প্রথম দিনেই এসে পড়ল পাহাড় প্রমাণ কাজের চাপ। বুঝিয়ে দেওয়া হল নতুন অফিসে ওয়র্ক লাইফ ব্যালেন্স বলে কিছু থাকবে না। শুধু কাজই থাকবে। নিয়মিত ওভারটাইম করতে হবে, তাও বাড়তি টাকা ছাড়াই। ম্যানেজারের দুর্ব্যবহারে প্রথম দিনেই চাকরি ছাড়লেন ইঞ্জিনিয়র।
নিজের নতুন অফিসের বিষাক্ত পরিবেশের কথা রেডিটে শেয়ার করলেন কর্মী। ওয়র্ক-লাইফ ব্যালেন্স বলে যে একটা শব্দ রয়েছে, এবং যা নিয়ে আজকাল আলোচনা বাড়ছে, তাঁকে অলীক কল্পনা, পশ্চিমী ধারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ম্যানেজার। খাতায় কলমে ৯ ঘণ্টার শিফট, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হয়েছে। কর্মী আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন কাজের বাইরে নিজের ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, নিজের জন্য সময় রাখতে চান, সে সব শুনে হাসি ঠাট্টা করেছেন ম্যানেজার। বাড়তি কাজ করলেও বাড়তি পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা ছিল না ওই সংস্থায়, তাছাড়া কর্মীদের কাজের বাইরেও একটা জীবন থাকতে পারে, ম্যানেজার তা বিশ্বাস করেন না, এতেই আপত্তি ছিল ওই কর্মীর।