যে কোনও শব্দের সঙ্গে, কোনও শব্দ জুড়ে দিলেই সব মিলে যায় না। সঠিক সময়ে সঠিক শব্দ মিলেমিশে অন্যরকম অর্থ তৈরি করে। ভারতীয় তবে অর্থনীতিতে কিন্তু এক অন্য শব্দের আমদানি এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি ভাষণেই প্রথম শোনা গিয়েছে, কনসার্ট ইকোনমি। এই শীতে কলকাতা এবং দেশে কনসার্টের পরিমাণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্রায়ান অ্যাডামস থেকে কোল্ড প্লে, একাধিক মেগা তারকা পারফর্ম করে গিয়েছেন ভারতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দাবি, এই কনসার্ট ইকোনমি আগামী দিনে দেশের উন্নয়নেও সাহায্য় করবে। এমনই দাবি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এই কনসার্ট ইকোনমি কী! তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড শুরু হয়ে গিয়েছে।
২০২৪ সালে দেশের সবথেকে বড় কনসার্ট করেছেন দিলজিৎ দোসাঞ্জ। তাঁর 'লুমিনাটি টুর' দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। দিল্লি, জয়পুর, মুম্বই, আহমেদাবাদ, কলকাতার মতো একাধিক মেট্রো সিটিতে কনসার্ট করেছেন দিলজিৎ। শুধু দিলজিৎ নন, দেশজুড়ে শো করেছেন শ্রেয়া ঘোষাল, মিকা সিং, প্রতীক কুহাদরা। এই কলকাতাতেও হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল শো। শহরে এসেছেন ব্রায়ান অ্যাডামসের মতো তারকা। বর্ষশেষে হয়েছে রাউন্ড টেবিল ইন্ডিয়া ও রিভার্ভের শো। ছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্পীরা।
দিল্লি, মুম্বই, আহমেদাবাদে গত বছরের শেষদিকে বড় বড় শো হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে মুম্বই কনসার্ট করে গিয়েছে মেরুন ফাইভ। আর সব শেষে মুম্বই ও আহমেদাবাদ মাতিয়েছে কোল্ড প্লে। আহমেদাবাদের শো-তে ২ লক্ষ ২৩ হাজার দর্শক এসেছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে এ দেশে আসছেন আরও এক আন্তর্জাতিক আর্টিস্ট এড শিরান। হায়দরাবাদ, চেন্নাই, দুটি শহরে শো করবেন এড শিরান।
এই কনসার্ট ইকোনমি কী!
যে কোনও সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থনীতির উড়ানকেই বলা হচ্ছে কনসার্ট ইকোনমি। লাইভ মিউজিক ইভেন্ট, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, কনসার্ট সমাজে একসঙ্গে অনেক মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে। একটি শো-তে প্রচুর টিকিট বিক্রি হয়। কোল্ডপ্লে বা ব্রায়ান অ্যাডামসের মতো আন্তর্জাতিক তারকা পারফর্ম করতে এলে, ওই কনসার্টের চাহিদা থাকে দেশজুড়ে। তাই স্থানীয় বাজারেও যার প্রভাব পড়ে। ওই এলাকায় হঠাৎ করেই হোটেল, রিসর্টের চাহিদা বেড়ে যায়। যাতায়াতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়। কনসার্ট সংলগ্ন এলাকায় দৈনন্দিন জিনিসের চাহিদা বেড়ে যায়। একটি ইন্টারন্যাশনাল কনসার্টকে ঘিরে বিভিন্ন সেক্টরে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়। সম্প্রতি কোল্ড প্লে-র কনসার্টে মুম্বই ও আহমেদাবাদে এটাই হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতিতে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে লাইভ মিউজিক কনসার্টের বাজারে ভ্যালু ছিল ৩৪.৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩০ সালে লাইভ মিউজিক কনসার্টের ভ্যালু দাঁড়াবে ৬০.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত কয়েক বছরে ভারতেও লাইভ কনসার্টের বাজারদর বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই মিউজিক কনসার্টের ভ্যালু বেড়েছে। ব্রায়ান অ্য়াডামস বা কোল্ড প্লে এর আগেও ভারতে লাইভ কনসার্ট করতে এসেছেন। এসেছেন গ্র্যামি জয়ী পপস্টার টেলর সুইফট। পারফর্ম করেছেন বিয়ন্সের মতো বড় নামও। ২০২৫ সালেও ভারতে আসছে আরও বড় বড় নাম। বছরের শুরুতেই এলেন চারবারের গ্র্যামী জয়ী ও অন্যতম বড় পপস্টার এড শিরান। তালিকায় আছেন গ্রিন ডে, ব্ল্যাকপিঙ্ক, শন মেন্ডেসের মতো পাওয়ারহাউজ। টিকিট প্ল্যাটফর্ম ও তার অনুসারী ইন্ডাস্ট্রিগুলি এই কনসার্টগুলি থেকে লক্ষ্মীলাভের প্রত্যাশা করছে। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার রিপোর্ট বলছে, লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট ও কনসার্টের জন্য ১৬০০-২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কনসার্ট থেকে প্রত্যাশিত মুনাফার পরিমাণ ৬০০০-৮০০০ কোটি টাকা। PWC সংস্থার রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে, মিউজিক কনসার্টের বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়াবে ২৪৫.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০২৪ সালে দেশের ৩১৯টি শহরে মোট ৩০,৬৮৭টি লাইভ শো ও কনসার্ট হয়েছে। কোল্ডপ্লে-র মুম্বই ও আহমেদাবাদের লাইভ কনসার্টের পর যেন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। গত কয়েকবছরের তুলনায় লাইভ এন্টারটেইনমেন্টের বাজারদর ১৮ শতাংশ বেড়েছে। শুধু মেট্রো সিটিতেই এই কনসার্টগুলি সীমাবদ্ধ নয়। টিয়ার ২ সিটিগুলিতেও হয়েছে বড় বড় ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ট। কানপুর, শিলং, গান্ধীনগরের মতো শহরে কনসার্টের বাজারদর বেড়েছে ৬৮২ শতাংশ। ব্রায়ান অ্য়াডামসের মতো মেগাস্টার শিলংয়ে শো করে গিয়েছেন। সামগ্রিক হিসেব ধরলে, গত বছর লাইভ মিউজিক, খেলা ও সিনেমায় টিকিট বিক্রির দর ছিল ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৫,৩৪৭ কোটি টাকা। কোভিড পরবর্তী যুগে যা সর্বাধিক। ২০১৭-২০২৪ সালে, এই কয়েকবছরে লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বাজারদর ২০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৪ সালের পর অন্য লাইভ ইভেন্টগুলি বাদ দিয়ে শুধু লাইভ মিউজিক ইভেন্টের বাজারদর ১৮৬৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। তবে ভারতে লাইভ ম্যাচ, বিশেষ করে ক্রিকেটের বাজারদর সবথেকে বেশি। ২০২৪ সালেও লাইভ ক্রিকেটের বাজারদর ছিল ৮,৮০০ কোটির কাছাকাছি।
লাইভ কনসার্টগুলির ডিজিটাল স্বত্ব পেতেও ঝাঁপিয়েছে বিভিন্ন স্ট্রিমিং সংস্থা। কোল্ডপ্লে-র অনুষ্ঠানের লাইভ স্ট্রিমিং কিনেছিল ডিজনি-হটস্টার। এই লাইভ কনসার্টে হটস্টারে ভিউজ এসেছে। ১৬.৫ কোটি মিনিটসের ওয়াচটাইমও এসেছে এই লাইভ কনসার্ট থেকে। যা স্ট্রিমিং ইতিহাসে নতুন নজির। ইভেন্ট ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞদের দাবি, এখন ভারত শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ নয়, সেটাই যেন প্রমাণ হয়ে গেল কোল্ডপ্লে-এর লাইভ কনসার্টে। আগামী কনসার্টগুলিতে ক্যাম্পেনিং তাই আরও জোরালো হবে। মানুষের আরও কাছে পৌঁছনোর জন্য নিজেদের একশো শতাংশ দেবে লাইভস্ট্রিমিং সংস্থা, টিকিট বিক্রেতা সংস্থা ও অন্যান্য স্পনসররা। এমনই মনে করছেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলি।