'তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব'
'স্বাধীনতা দেওয়া হয়না, ছিনিয়ে নিতে হয়'
'মনে রাখতে হবে যে সবচেয়ে বড় অপরাধ হল অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ'
অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ তিনিও কোনওদিন করেননি । স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন । মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, ব্রিটিশদের হিটলারি শাসন থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন দেশবাসীকে । দেশের জন্য কী করেননি ? আন্দোলন করেছেন, ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন । নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ছদ্মবেশে জার্মানি, জাপান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন । নিজের নীতিকে কোনওদিন বিসর্জন দেননি, লক্ষ্য়ে অবিচল থেকেছেন আমৃত্যু । মৃত্যু নাকি অন্তর্ধান, সে আজও স্বাধীনতাত্তোর বাঙালির জীবনে এক গভীর রহস্য । কিন্তু দেশবাসীর কাছে তিনি অমর । নমস্কার, আমি শুভশ্রী । আজ আমরা দেশের সেই যোদ্ধা, বিপ্লবী বীর নেতাজিকে নিয়েই কথা বলব । তাঁর আত্মত্যাগের কথা কারও অজানা নয়, কিন্তু আজ আমরা জানব, তাঁর জীবনের এক অন্য দিক সম্পর্কে, তাঁর হৃদয়ের গল্প, তাঁর জীবনের ভালবাসার গল্প । নেতাজির লভ স্টোরি ।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু । একজন মেধাবী ছাত্র,দুর্ধর্ষ নেতা, একজন বীর-বিপ্লবী । কিন্তু, তিনি তো একজন সাধারণ মানুষও । তাঁর হৃদয়ও তো কারও জন্য প্রেমে-বিরহে উথাল-পাথাল করেছে । সুভাষের জীবনে সেই বিশেষ নারীর নাম এমিলি শেঙ্কল । নেতাজির জীবন-কাহিনি নিয়ে পড়াশোনা করার সময় তাঁর কথা নিশ্চয় অনেকবার শুনেছেন আপনারা । কিন্তু, কে ছিলেন এই এমিলি, কীভাবে শুরু হয়েছিল সুভাষ-এমিলি-র প্রেম ? জানব আজ
অস্ট্রিয়ার মেয়ে এমিলি । ১৯১০ সালে অস্ট্রিয়ার এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম তাঁর । বাবা পশু চিকিৎসক । তবে, মেয়ে এমিলির উচ্চশিক্ষা নিয়ে একেবারেই আগ্রহ ছিল না তাঁর বাবার । তাই অনেক লড়াই করেই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন । টাইপিংয়ে দক্ষ ছিলেন এমিলি । আর সেই সূত্র বেঁধেছিল সুভাষ ও এমিলিকে ।
এমিলি-সুভাষের প্রথম দেখা ও প্রেম
সালটা ১৯৩২-১৯৩৪-এর মধ্যে । আইন অমান্য করার জন্য ব্রিটিশ সরকার নেতাজিকে গ্রেফতার করে । কিন্তু, জেলে বন্দী থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নেতাজি । তারপর ইউরোপে তাঁকে নির্বাসিত করা হয় । অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে ছিলেন বোস । সেখানে চিকিৎসার পর বোস ঠিক করেন স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য ইউরোপে বসবাসকারী ভারতীয় ছাত্রদের একজোট করবেন। সেইসময় ইউরোপের এক পাবলিশার্স নেতাজিকে ইন্ডিয়ানদের স্ট্রাগলদের উপর বই লেখার কাজ দেন । তার জন্য একজন সেক্রেটরির প্রয়োজন ছিল সুভাষচন্দ্রের । যাঁর ইংরেজি ভাষার উপরে যথেষ্ট দক্ষতা থাকবে এবং টাইপিংয়েও চোস্ত । কিন্তু সেই সেক্রেটরির প্রেমেই সুভাষ পড়বেন, তা কেই বা জানত ।
এমিলি ও সুভাষের মধ্যে একজন কমন ফ্রেন্ড ছিলেন । ভারতীয় পদার্থবিদ ডক্টর মাথুর । এই মাথুরই এমিলিকে সুভাষচন্দ্রের কাছে নিয়ে আসেন । সেই প্রথম পরিচয় । তারপর একসঙ্গে কাজ করতে করতে কখন যে ২৩-এর এমিলিকে মন দিয়ে ফেললেন ৩৭-এর সুভাষ !
এমিলি-সুভাষের বিয়ে
এমিলির সঙ্গে সুভাষের বয়সের পার্থক্য ছিল ওই ১৪ বছর । কিন্তু, বয়স কখনও প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি । এমিলির এন্ট্রি সুভাষের জীবনকে পুরো পাল্টে দিয়েছিল । এরই মধ্যে সুভাষের কাছে কিন্তু পরপর বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে । জানা গিয়েছে, সুভাষকে জামাই হিসেবে পেতে এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন এক পাত্রীর বাবা । কিন্তু, সুভাষের মন যে একজনই অধিকার করে নিয়েছিলেন । এমিলি ।
জানা গিয়েছে, সুভাষই নাকি প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এমিলিকে । কিন্তু, সুভাষের সঙ্গে সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি এমিলির বাবা । তবে, সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর বাবা মন পাল্টে ফেলেন । দু'জনের সম্পর্কের গভীরতা যে কতটা ছিল, তার প্রমাণ তো বিভিন্ন চিঠিতেই পাওয়া গিয়েছে ।
জানা গিয়েছে, ১৯৩৭ সালে গোপনে দু'জনে বিয়েও করেন । হিন্দু রীতি মেনেই বিয়ে হয় দু'জনের । ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁদের কন্যা অনিতার জন্ম হয় । স্ত্রী ও সন্তানের কথা অনেকদিন গোপনেই রেখেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু ।
নেতাজি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । দেশের স্বাধীনতার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন, ভিটেমাটি ছেড়েছিলেন । দেশের প্রতি এক অবিচল আনুগত্য ছিল । নেতাজি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কখনওই দেশের উপরে রাখেননি । এমিলিকেও না । এমিলিও নেতাজির কর্তব্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি । নেতাজির দেশপ্রেমকে সম্মান জানিয়েছেন ।
স্ত্রী ও কন্যাকে রেখেই মিশনে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নেতাজি । কিন্তু, তারপর আর ফেরেননি । জানা গিয়েছে, এমিলিকে লেখা সুভাষের শেষ চিঠি ছিল...'প্রাণে বেঁচে নাও থাকতে পারি, তোমাকে আর নাও দেখা দিতে পারি, ফাঁসি হতে পারে অথবা গুলি লাগতে পারে । তবুও জানবে তুমি আমার হৃদয়ে রয়েছো । এই জন্মে না হলেও পরের জন্মে আমরা একসঙ্গে থাকব'...।
এমিলি মেয়েকে একাই বড় করে তুলেছেন । কম কষ্টে তাঁরা দিন কাটাননি । সুভাষের পরিবারের থেকেও কোনওদিন সাহায্য নেননি । সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গোপনীয়তা শেষপর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন । সুভাষের স্মৃতিকে আঁকড়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন ।
এখানে নেতাজির প্রেমজীবন নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন আরেকজনের কথা না বললেই নয় । তিনি পদ্মজা নাইডু । তাঁর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর সম্পর্ক নিয়ে চর্চা রয়েছে । কোনওদিন বিয়ে করেননি পদ্মজা । তবে, সুভাষের প্রতি নাকি দুর্বলতা ছিল নেহরুর । কয়েকটি চিঠি থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে । যদিও তার সত্যতা যাচাই করেনি এডিটরজি বাংলা ।
নেতাজির মৃত্যু নিয়ে অনেক রহস্য, গোপনীয়তা, মিথ রয়েছে । কেউ বলেন, তাইহোকুতে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়। আবার কারও মতে, ওই বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি ।
কেউ বলেন আবার, যুদ্ধবন্দি হিসেবে রাশিয়ার কারাগারে সুভাষের মৃত্যু হয়েছে। মস্কোতে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত সাইবেরিয়ার ওমসক শহরের কারাগারে নেতাজিকে দেখতে গিয়েছিলেন । কথা বলতে পারেননি, প্রবল ঠান্ডায় উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছিল নেতাজিকে। এমন একটি তথ্যও সামনে এসেছিল বেশ কয়েক বছর আগে।
বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর নাকি অন্য কোনও সময়, অন্য কোথাও বা অন্য কোনওখানে? উত্তর আজও অজানা ।