জানুয়ারির লখনৌ। রোদ গায়ে পড়ছে, কিন্তু গা তাতছে না, বরং আরাম লাগছে। লখনৌতে আজ দ্বিতীয় দিন।
এবার পিটিসি
ভগ্নপ্রায় রেসিডেন্সির আনাচে কানাচে একটু একটু করে সকাল এগোচ্ছে দুপুরের দিকে। লোহার বেঞ্চিতে কোথাও প্রেমিকার কাঁধে মাথা রেখে প্রেমিক, কোথাও বন্ধুদের দু দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া। আপাতভাবে ঘটছে না তেমন বড় কিছুই। আর ছোট, আরও ছোট, কিমবা বড়, সব ঘটনার সাক্ষী থাকছে রেসিডেন্সির প্রতিটা ইঁট, আড়াই'শ বছর ধরে।
রেসিডেন্সি তৈরি করিয়েছিলেন লখনৌয়ের নবাব আসফ-উদ-দৌলা। হ্যাঁ, ভুলভুলাইয়া, বড়া ইমামবড়া যার আমলে হয়েছিল, সেই আসফ-উদ-দৌলা। রেসিডেন্সি শুরু হয়েছিল তাঁর আমলে। আর শেষ যখন হলো, ১৮০০ সাল, লখনৌ-এর মসনদে তখন নবাব সাদাত আলি খান। ++ এই রেসিডেন্সি আসলে ছিল ব্রিটিশ রেসিডেনট জেনারেলের বাসভবন।
বেলি গেট দিয়ে রেসিডেন্সির ভেতরে ঢুকে প্রথমেই ডান হাতে পরবে কোষাগাঢ়, দাওয়াতখানা নবাব সেখানে দাওয়াত দিতেন, দাওয়াত খানার প্রায় উল্টোদিকেই ডক্টর ফ্রেরারের বাসভবন পেরিয়ে বেগম কুঠি। বেগম কুঠির সঙ্গেই রয়েছে একটা মসজিদ, সঙ্গে ইন্দো ইওরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি একটি ইমামবারা। এর পরেই মূল রেসিডেন্সি, যার নাম থেকে গোটা চত্বরের নাম হয়ে গিয়ছে রেসিডেন্সি।
শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল রেসিডেন্সি। জেনারেলের বাসভবন কীভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল? সিপাহী বিদ্রোহের আগুন বাংলার ব্যারাকপুর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতেই। ব্রিটিশ সেনা আধিকারিকদের ওপর তীব্র রাগ মনে পুষে রেখেছিলেন পরাধীন ভারতের হিন্দু-মুসলিম-শিখ সব ধর্মের সেনারাই। সেই রাগ বদলে যাচ্ছে বিক্ষোভে। বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন ভারতীয় সৈন্যরা। পর পর আঘাত এল রেসিডেন্সির গায়ে। রেসিডেন্সির গায়ের গোলাগুলির চিহ্ন, আসলে সেই আঘাতেরই চিহ্ন। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের নির্বাসনের পর তাঁর বেগম হজরত মহল তাঁর সেনা নিয়ে রেসিডেন্সি আক্রমণ করেন।
১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহকে ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতার প্রথম লড়াই হিসেবে ধরা হয়। এ বছরের জুলাই মাস নাগাদ রেসিডেন্সিতে ভয়াবহ গোলাগুলির পর তৎকালীন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট হেনরি লরেন্সের মৃত্যু হল। ভারতীয়দের গুলিবর্ষণে মৃত্যু হল তাঁর উত্তরাধিকারেরও মৃত্যু হয়। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাসে ইংরেজরা বুঝতে পারেন, লখনৌর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব না। ২২ নভেম্বর, ইংরেজরা রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে গেলেন। ১ বছর পর ফিরে এল ব্রিটিশ আধিপত্য। এবার আরও সরাসরি, ভারত চলে এসেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। এর পর স্বাধীন ভারতে সূর্য উঠবে আরও ৯০ বছর পরে। কিন্তু, ১৮৫৬-৫৭-র বিদ্রোহ, রেসিডেন্সিতে লাগাতার আক্রমণ, ৯ দশক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, পরাধীনতার শেকলটা আলগা হতে শুরু করেছে, শেকল ভাঙবেই।