রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা দাবি করেন, ২০২৪ সালের ৯ অগাস্ট থেকে ওই বছরের ২১ অক্টোবর, এই সময়কাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সবচেয়ের বড় হার্ডলের মুখোমুখি হতে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তার প্রধান কারণ ছিল আরজি কর হাসপাতাল। পরিসংখ্যানে অভিযোগ করা হয়, গত কয়েক বছরে এই রাজ্যে বেশ চোখে পড়ার হারে বেড়েছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। কিন্তু শহর কলকাতার উপরে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে একজন মহিলা সরকারি চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল মমতা সরকারকে।
আর এখানেই তৃণমূল নেত্রীর ক্যারিশ্মা। রাজনৈতিক মহল দাবি করে, নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গেই বাগে এনেছেন শহর কলকাতায় তৈরি হওয়া জনগর্জনকে। সোমবার তাঁর নজরও ছিল শিয়ালদহ আদালতের দিকে। তাই মুর্শিদাবাদ যাওয়ার আগে, আরজি করের ঘটনায় সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রায়ের পর হতাশ মুখ্যমন্ত্রী জানান, ফাঁসি হলে সান্ত্বনা পেতেন। কেন এই ঘটনা বিরলতম নয়, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মালদহে তিনি জানান, আরজি কর মামলায় দোষী সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি চেয়ে হাই কোর্টে যাবে রাজ্য। মঙ্গলবার সেই নির্দেশ কার্যকর করেছেন অ্যাডভোকেট জেলারেল কিশোর দত্ত। শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, আরজি কর মামলায় গোড়া থেকেই দোষীদের চরম শাস্তির দাবি করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। শিয়ালদহ আদালতের রায়ের পর তাঁর প্রতিক্রিয়া, জনগনের করের টাকায় নারকীয় এই ঘটনার দোষীকে জেলে রেখে কী লাভ ?
আরজি করের ঘটনায় দোষী সঞ্জয়ের ফাঁসি চাওয়ার পিছনে রাজ্যের যুক্তি, যদি পুলিশি মামলায় গত চার মাসে মাটিগাড়া থেকে গুড়াপের ঘটনায় আদালত ফাঁসির সাজা শোনাতে পারে, তাহলে এত হাইপ্রোফাইল কেসের তদন্তভার হাতে নিয়ে সিবিআই কেন পারল না ? আরজি কর রায়ের পর এই উত্তর নেই বিরোধী বিজেপি ও বামেদের কাছেও।
সোমবার আরজি কর মামলায় সাজা শোনাতে গিয়ে বিচারক অনিবার্ণ দাসের পর্যবেক্ষণ ছিল, এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়। নিজের রায়ে বিচারক জানিয়েছেন, বিচারব্যবস্থায় প্রাথমিক দায়িত্ব হল আইনের শাসনের ভুল ধরা। এবং প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারকে সুনিশ্চিত করা। জনমত দেখা নয়। আবেগে না ভেসে বিচারের সময় উঠে আসা তথ্য প্রমাণের উপর গুরুত্ব দিয়ে নিরপেক্ষতা ও সত্যকে রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
রাজ্যের আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আরজি কর মামলায় বিচারক অনিবার্ণ দাসের এই রায়ের মধ্যে রয়েছে এক যুগান্তকারী ইঙ্গিত। কারণ নিজের পর্যবেক্ষণে বিচারক দাস এও উল্লেখ করেছেন, জীবনের আদিম প্রবৃত্তি থেকে সবাইকে উঠে দাঁড়াতে হবে। হিংসার বিরুদ্ধে হিংসাকে দাঁড় করানো নয়। বরং মানবতা, সহানুভূতি এবং বিচারের গভীর বোধ দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।
দিনটা ছিল ১৪ অগাস্ট। স্বাধীনতার প্রাক-রাতে এক অন্য আন্দোলনের ছবি দেখেছিল কলকাতা। একটা মেয়ের সাজার দাবি রাত জেগেছিল এই শহর। ঘটনার ১৬৪ দিন পর কী পেল নির্যাতিতার পরিবার। বাবা জানিয়েছেন, সবে প্রাথমিক ধাপ পার হওয়া গিয়েছে। মায়ের অভিযোগ, এই মামলায় ব্যর্থ হয়েছে সিবিআই। তাঁরাও যাবেন কলকাতা হাই কোর্টে। সঞ্জয়ের ফাঁসি চাইতে।
এসবের মধ্যের রাজ্যের রাজনীতির কারবারিদের দাবি, হাতের বাইরে চলে যাওয়া একটি পরিস্থিতিকে নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে বাগে এনে বিরোধীদের ফের কয়েক মাইল পিছনে ফেলে দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি ভাবে আরজি করের ঘটনায় দোষী সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, নির্যাতিতার পরিবারকে বিচার দিতে সেদিনও তিনি চেয়েছিলেন, আজও তিনি চান।