কলকাতার পাতাল প্রবেশ। চার দশক আগে এমন এক অক্টোবরে এটাই ছিল বাংলার এক দৈনিকের শিরোনাম। ব্রড গেজ, ন্যারো গেজ, মার্টিন রেল-সহ রেলের নানা বিবর্তনের সাক্ষী এই শহর। পাশাপাশি হাঁটল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সুড়ঙ্গ ভেদ করে ছুটে ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এক রূপকথা তৈরি করল কলকাতা মেট্রো। ৪০ বছর পর আজ যা ইতিহাস।
১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর। কলকাতার বুকে তৈরি হল এক দৃষ্টান্ত। যা হয়তো আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মাটির নিচ দিয়ে যাত্রা শুরু করল রেল। যার নেপথ্যে স্যার হার্লি।
১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম কলকাতা মেট্রোর মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। মোট ৯৭.৫ কিলোমিটার মেট্রো লাইনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ভাবনাচিন্তায় ছিল মোট তিনটি করিডর। তার মধ্যে ছিল দমদম থেকে টালিগঞ্জ, বিধাননগর থেকে রামরাজাতলা এবং দক্ষিণেশ্বর থেকে ঠাকুরপুকর। এরপর ১৯৭২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মেট্রো পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। এবং তার ১২ বছর পর পরিষেবা শুরু হয়।
১৯৮৪ সালের অক্টোবরে প্রথম যখন কলকাতায় মেট্রো পরিষেবা শুরু হয় তখন মাত্র ৩.৪ কিলোমিটার যাত্রা করা যেত। প্রথম মেট্রো চলতে শুরু করে এসপ্লানেড থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত, মোট ৫টি স্টেশনের মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে মেট্রোর গতিপথ বেড়েছে। বর্তমানে ৩৭টি স্টেশন রয়েছে। মোট মেট্রোপথের বেশ কিছুটা অংশ মাটির উপরেও তৈরি করা হয়েছে।
তারপর ওই বছরই দমদম থেকে বেলগাছিয়া পর্যন্ত ২.১৫ কিমি পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার পরিষেবা শুরু হয়। তৃতীয় দফায় ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল পরিষেবা শুরু হয় ভবানীপুর থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত পরিষেবা। সেইসময় মোট স্টেশন সংখ্যা ছিল ১১টি।
শুরুর দিনগুলি-
১৯২১ সালে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। স্যার হার্লি একটি বই লিখেছিলেন। যার নাম ক্যালকাটা টিউব রেলওয়েজ। ওই বইতে কলকাতা মেট্রোর একাধিক ড্রয়িং ছিল। এমনকি মেট্রো প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে কত টাকা খরচ পড়বে তার হিসেবও উল্লেখ করা হয় ওই বইতে। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, কলকাতা মেট্রোতে যে সব রেকগুলি ব্যবহার করা হবে সেই সব রেকে আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
১৯২১ সালে কলকাতা মেট্রো রেলের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও তহবিলের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। তার প্রায় ৫০ বছর পর মাস্টার প্ল্যান এবং ৬৩ বছর পর পরিষেবা চালু হওয়ার পর গোটা বিশ্বের ইতিহাসে লেখা হল কলকাতার নাম।
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর গঙ্গার তলা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে মেট্রো। এই অংশটি হাওড়া ও সল্টলেকের আরও বৃহত্তর একটি সংযোগের একটি অংশ। এই অংশের পরিকল্পনাও করেছিলেন স্যার হার্লি। ইতিমধ্যে এসপ্লানেড থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত পরিষেবা শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০২৩ সাল থেকেই ওই পরিষেবা চালু হয়।
কলকাতা মেট্রোর খুঁটিনাটি-
কলকাতা ভূগর্ভস্থ রেলে মূলত দুই ধরনের লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। ব্লু লাইনে রয়েছে ব্রড গেজ, যা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া এবং গ্রিন লাইনে ব্যবহার করা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড গেজ যা ৪ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি চওড়া। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে ৭৫০ ভোল্ট DC থার্ড রেল ইলেক্ট্রিফিকেশন সিস্টেম।
প্রথমের দিকে মেট্রো রেলের যে টানেল তৈরি করা হয়েছিল তা Cut and Cover পদ্ধতিতে। অর্থাৎ মূল রাস্তা উপর থেকে কেটে টানেল তৈরি করে তারপর উপরে ফের রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে টানেল বোরিং মেশিন ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় মেট্রোর সুরঙ্গ।
প্রথম পরিষেবা শুরুর ৪০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কলকাতা মেট্রোর সামনে এসেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান করে সামনের দিকে ছুটে চলেছে ভূগর্ভস্থ রেল। তাই হয়তো কলকাতা বাসী এখনও জোর গলায় বলতে পারে, 'কলকাতা মেট্রো, আমাদের গর্ব', ভালো থেকো কলকাতার হৃৎপিন্ড।